উপকূল ঘেঁষা ধুমঘাট গ্রামের বাসিন্দা অল্পনা রাণী মিস্ত্রি। গ্রামের আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ, কর্দমাক্ত রাস্তা সবকিছু পেরিয়ে যেতে হয় তার বাড়ি। সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ধুমঘাট গ্রামের এই বাসিন্দা নিজ বাড়িতেই গড়ে তুলেছেন বিলুপ্ত অচাষকৃত শাক-সবজি, ওষুধি ও ফলমূলের বীজ ভান্ডার। পেয়েছেন শেখ হাসিনার থেকে পাওয়া পুরষ্কারও।
প্রত্নতত্ত্ব এলাকায় থেকে ও বিলুপ্ত অচাষকৃত শাক-সবজি, ওষুধি ও ফলমূলের বীজ সংগ্রহ করেছেন প্রায় ৫৫০ জাতের। তার বীজ ভান্ডারে রয়েছে অচাষকৃত কিন্তু পুষ্টিগুণ সম্পন্ন নানা উদ্ভিদ বৈচিত্রের বীজও। ২২ প্রকার শিম, আট প্রকার ডাটাশাক, ১০ প্রকার মরিচ, শতাধিক ওষুধি, ৫০-৬০ প্রকার সবজি, ২২ প্রকার অচাষকৃত উদ্ভিদসমূহ।
ছায়া সবুজময় গ্রামের মাঠে ঘাঠে দেখা যায় গরু ছাগলের বিচারণ। মাটির রাস্তার ঘ্রাণ নিয়ে অল্পনা রানীর বাড়িতে ঢুকতেই চোখে মেলে বীজ রাখার ঘর, যেখানে বোয়ামে, প্যাকেটে বা বস্তায় রাখা হয়েছে বীজ। এই বীজ দিয়েই চাষাবাদ করেন অল্পনা রানী, বিতরণ করেন গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের মাঝেও।
অল্পনা রানীর মতে, স্থানীয় জাতের বীজ চাষাবাদে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে না। এই বীজ থেকে উৎপাদিত ফসলের বীজ সংরক্ষণ করা যায়। জৈব পদ্ধতিতে চাষ করা যায় বলে মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে। আমরা রাসায়ানিক সার ও কীটনাশক দেওয়া শাক সবজি খেয়ে আমরা দুর্বল হয়ে পড়ছি। যার কারণে আমাদের জৈব পদ্ধতিতে বীজ সংরক্ষণ করতে হবে।
তিনি স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণ না করলে কৃষককে কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যেতে হবে। কারণ আমরা যদি বীজ সংরক্ষণ না করি তো এক সময় আমাদের কৃষকদের কাছে কোনো প্রকার বীজ থাকবে না। ফলে আমাদের বীজ প্রয়োজন হলে তাদের কাছে হাত পাততে হবে। তাই সেখান থেকে ২০১০ সাল থেকে আমি বীজ সংরক্ষণ শুরু করি।
এজন্য স্থানীয় কৃষকদের সাথে বীজ বিনিময়ের মাধ্যমে দেশীয় বীজ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে সাধারণ কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছেন তিনি। গড়ে তুলেছেন বিষমুক্ত সবজির খামার এবং সংরক্ষণ করে রেখেছেন বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া অনেক শাকসবজি। যা সচারচর বাড়ির আনাচে কানাচে জন্মাতো কিন্তু এখন আর সেগুলো চোখে মেলে না। তবে তার বাড়ির আঙিনায় গেলে দেখা মিলবে সেইসব বিলুপ্ত প্রায় শাকসবজির সাথে।
স্থানীয় বীজ সংরক্ষণে তিনি নিজে কিভাবে উদ্বুদ্ধ হলেন জানতে চাইলে বার্তা২৪.কম’কে অল্পনা রানী বলেন, ২০১০ সাল থেকে আগে দু’একটি বীজ রাখতাম। ২০১২ সালে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজেনাস নলেজ (বারসিক) আমাকে বীজ সংরক্ষণে উদ্বুদ্ধ করে এর গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝায়। প্রশিক্ষণও দেয়। নানাভাবে সহায়তাও করে। বারসিকের উৎসাহ পেয়েই আমি বীজ সংরক্ষণ শুরু করি। যা এক যুগের ব্যবধানে বীজ ভান্ডারে পরিণত হয়েছে।
তিনি বলেন, হাইব্রিড বীজ কিনে কৃষকরা প্রতিনিয়ত ঠকছে। হাইব্রিড বীজ চাষ করতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে, হাইব্রিড বীজের ফসল থেকে বীজ রাখাও যায় না। এখন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দিয়ে উৎপাদিত ফসল খেয়ে মানুষের নানা রকম রোগ বালাই হচ্ছে। আর বীজ রাখতে না পারায় কৃষক কোম্পানির কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে।
বিপরীতে স্থানীয় জাতের বীজ চাষ করতে কোনো রকম রাসায়নিক সার ও কীটনাশক লাগে না। জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেই ফসল উৎপাদন করা যায়, এর বীজও রাখা যায়, মানুষের স্বাস্থ্যও ভালো থাকে- যোগ করেন তিনি।
তিনি বলেন, স্থানীয় জাতের বীজ সংরক্ষণের মাধ্যমেই কৃষক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করতে পারে। এর মাধ্যমে প্রান্তিক মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা অর্জনের পাশাপাশি পুষ্টি চাহিদাও নিশ্চিত করা সম্ভব। এজন্য কোনো বীজই আমি হারিয়ে যেতে দেই না।
অল্পনা রানীর মতে, উপকূলীয় দুর্যোগ প্রবণ এলাকায় বীজ সংরক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, প্রতিবছর শ্যামনগর উপকূলে অন্তত দুটি করে ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে। এতে অনেক সময় রোপণকৃত বীজ নষ্ট হয়ে যায়। অনেক বীজ হারিয়ে যায়। এমন সময় কৃষকের হাতে বীজ থাকলে তিনি আরও রোপণ করতে পারেন। কিন্তু বীজ না থাকলে আবার কেনা ছাড়া উপায় থাকে না।
কীটনাশকের বদলে ফসলের ক্ষেতে জৈব বালাইনাশক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করে তিনি বার্তা২৪.কম’কে বলেন, আমি নিমপাতা ও মেহগুনির ফল দিয়ে বালাইনাশক তৈরি করি। এছাড়া সহনীয় মাত্রায় ডিটারজেন্ট মিশ্রিত পানি স্প্রে বা ঘুটের ছাই কিংবা তুতে ও চুন দিয়ে মিকচার তৈরি করে ক্ষেতে ব্যবহার করি। বালাইনাশক হিসেবে এগুলো খুবই উপকারী।
বীজ সংরক্ষণ ও স্থায়িতশীল কৃষি চর্চার জন্য তিনি পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিও। এজন্য সংশ্লিষ্টদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশে ভোলেননি স্বশিক্ষিত কৃষাণী ও খাদ্য যোদ্ধা অল্পনা রানী মিস্ত্রী।
তিনি বলেন, নদী পার হতে গেলে যেমন সাঁকো লাগে, বারসিক আমার জীবনে সেই সাঁকো হিসেবে কাজ করেছে। আমার জীবনে আলো দিয়েছে। জ্ঞানের আলো। যদি তারা আমাকে কোনো অনুদান দিতো, হয়তো তা খেয়ে ফেলতাম। কিন্তু তারা তা না দিয়ে আমাকে দিয়েছে জ্ঞানের আলো। এই জ্ঞানের আলোয় আমার জীবন ভরে উঠেছে। এটাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় পুরস্কার। এছাড়াও আমি ২০১৪ সালে বঙ্গবন্ধু কৃষি পদক, ২০২০ সালে অন্যান্য পুরস্কার, উপজেলা জেলা ও বিভাগীয় পর্যায়ে জয়িতা পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার পেয়েছি। দেশ বিদেশের টেলিভিশন চ্যানেল আমাকে নিয়ে প্রতিবেদন করতে আসে। আমার জীবনে আর কী চাওয়া আছে?