বোধহয় বৈরি সময়ে উর্বর মস্তিষ্কে চিন্তারা বেশি করে ভিড় করে। মৌলিক প্রতিভা সে চিন্তাকে ঘনীভূত করে জমাট বাধায়, উপহার দেয় চিন্তা বা কল্পনা করতে না পারা মানুষদের জন্য অভিনব কিছু। সাহিত্যে কবিতার যে শক্তি তা কম কবির লেখনিতেই মূর্ত হয়েছে কালেভদ্রে। কিন্তু মানুষের মুক্তির আকাঙ্খাকে ধারণ করে যে শব্দের সমষ্টি অজস্র পীড়িতের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় সেই তো সার্থক কবিতা। আর তার নির্মাতাই হয়ে উঠেন সার্থক কবি।
কবিতার এই যে মানদণ্ড তাতে একজন হেলাল হাফিজ অনেক আগেই উত্তীর্ণ। ৭ অক্টোবর বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান এই কবির জন্মদিন। কিন্তু কি আশ্চর্য! দুঃখকে নিত্যসহচর করে বেঁচে থাকা অধিকাংশ কবিদের অমোঘ নিয়তি হেলাল হাফিজকেও ছাড়েনি। ১৯৪৮ সালে নেত্রকোণায় জন্ম নেওয়া কবিতার এই বরপুত্র নব্যঔপনিবেশিক শাসকদের রোষানল দেখেছেন। দেখেছেন মুক্তির আকাঙ্খায় উদ্ভাসিত বাঙালি জাতির ব্যগ্রতা।
যৌবনের উদ্দাম দিনে দ্রোহ ও প্রেম-দুই-ই পেয়ে বসেছিল হেলাল হাফিজকে। তাকে অবলম্বন করতেও ছাড়েননি তিনি! সহজ কথায় তিনি ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন সবার কথাকে, তাইতো তিনি উত্তীর্ণ হয়েছেন তাঁর সমকালীনতাকে। অন্তত ৫ দশক ধরে বাংলা সাহিত্যে কবিতার এই বরপুত্র সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে বার বার প্রাসঙ্গিক হয়ে ফিরে এসেছেন। এই সময়েও তাঁর কবিতার ঐশ্বর্য ম্লান হয়নি এতটুকুও! এখানেই তাঁর সার্থকতা।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে বাংলা সাহিত্যে অপেক্ষাকৃত এক বন্ধ্যা সময়েও মুগ্ধ পাঠকের মুখে উচ্চারিত হচ্ছে হেলাল হাফিজের শব্দগাঁথা, যা তিনি জীবন অভিজ্ঞতা ও সঞ্চিত বিশ্বাসে ভর করে লিখেছিলেন বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের তপ্ত আবহের মাঝে। ‘এখন যৌবন যার জুদ্ধে যখন তার শ্রেষ্ঠ সময়’-কবি হেলাল হাফিজের শক্তিশালী শব্দমালা এখনও পথে-প্রান্তরে দেয়ালে উৎকীর্ণ, হয়তবা এই পঙতির চিরকালীন আবেদনময়তার জন্যই।
‘যে জলে আগুন জলে’ কাব্যগ্রন্থের প্রতিটি কবিতার ছত্রে ছত্রে দ্রোহ ও প্রেমের যে আখ্যান কবি সৃষ্টি করেছেন তা কয়েক দশক পরে এখনও পাঠককে মুগ্ধ করে। মুগ্ধ করে বললেও অত্যুক্তি হবে-বলা প্রয়োজন আন্দোলিত করে।
২০১৩ সালে সাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে কবিকে বাংলা একাডেমি পদকে ভূষিত করা হয়। ২০১৯ সালে কবি পাঠকদের উপহার দিয়েছেন ‘বেদনাকে বলেছি কোঁদো না’ কাব্যগ্রন্থ। সঙ্গীহীন ব্যক্তিগত জীবনে কল্পনালোকে ডুবে থাকতেই পছন্দ করেন কবি।
তবে ঘুমন্ত সমাজকে জাগিয়ে তুলতে যে প্রবল শক্তি নিয়ে একজন হেলাল হাফিজ আবির্ভূত হয়েছিলেন তার সামান্যই হয়ত নিতে পেরেছি আমরা। কবিতার শক্তি যে সত্যসুন্দরের আহ্বান নিয়তই জানিয়ে যায় এই সমাজ হয়ত তাকে সর্বাঙ্গীন স্বাগত জানাতে প্রস্তুত নয়।
তা সত্ত্বেও সত্যসুন্দরের দীপশিখা জ্বেলে যান কবি হেলাল হাফিজ। শুভ জন্মদিন কবি।