‘বেসরকারি খাতকে আরো চাঙ্গা করতে নজর দিতে হবে’

, অর্থনীতি

| 2024-10-16 13:50:19

৫ আগস্ট-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক গতিশীলতা আনতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে প্রাধান্য দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এনভয় লিগ্যাসি ও শেলটেক গ্রুপের চেয়ারম্যান কুতুবউদ্দিন আহমেদ। বাংলাদেশ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিজিএমইএ) এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।

দেশের রফতানি খাত, প্রবাসী কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধিসহ অভিজ্ঞতার আলোকে সংস্কারসহ অর্থনীতির গতি-প্রকৃতি নিয়ে নিজের ভাবনার কথা জানিয়েছেন এই ব্যবসায়ী। বণিক বার্তা’য় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারটির সংক্ষিপ্তরূপ বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য প্রকাশিত হলো:

দেশের বর্তমান সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের কোন দিকগুলোয় নজর দেয়া প্রয়োজন?

কুতুবউদ্দিন আহমেদ: বর্তমানে বাজারে অস্থিরতা বিরাজমান। চাঁদাবাজি যদি আমরা বন্ধ করতে পারি তাহলে জিনিসপত্রের দাম এমনিতেই কমে যাবে। এক্ষেত্রে যদি রাজনীতিবিদদের সম্পৃক্ত করা যায় এবং পুলিশকে যদি দায়বদ্ধতার ভেতর আনা যায় তাহলে এটা দূর করা সম্ভব। চাঁদাবাজির দুটি স্থান হলো ট্র্যাফিক জ্যাম এবং ফুটপাত দখল করে থাকা দোকানপাট। এতে পণ্যের দাম বাড়ে। প্রত্যেক এলাকার থানার দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ অফিসার নিজ এলাকার ফুটপাতকে দখলদারত্ব থেকে মুক্ত রাখতে পারেন, তাহলে চাঁদাবাজি বিশালাকারে কমে যাবে। চাঁদাবাজির মহামারী একটি উৎস হলো পোশাক শিল্প। কাটিং ওয়েস্টেজের ক্রয় নিয়ে সন্ত্রাসীদের মাঝেই প্রতিযোগিতা চলে। কোনো পোশাক কারখানাই সঠিক দামে সেই ওয়েস্টেজ নিজ থেকে বিক্রয় করতে পারে না, এক্ষেত্রে তারা বন্দি সেই চাঁদাবাজ সন্ত্রাসীদের কাছেই। তাদের কাছে বিক্রয় করে দিতে হয় প্রায় অর্ধেক দামে, কোনো দরদামের সুযোগও নেই সেখানে। তাদের দাবি না মানলে কারখানার সংশ্লিষ্টদের রাখা হয় হুমকির ওপর। দেশের নানা কারখানাকে হিসেবে আনলে আনুমানিক দৈনিক ৫ থেকে ১০ কোটি টাকার ওয়েস্টেজ বিক্রি হচ্ছে এ সন্ত্রাসীদের কাছে, এমনটিই শোনা যায়। যদি পোশাক কারখানাগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো দরদাম করে যথাযথ জায়গায় ওয়েস্টেজ বিক্রি করতে পারে, তাহলেই নিশ্চিতভাবে বোঝা যাবে যে দেশে আইন-শৃঙ্খলা সুসংহত অবস্থায় রয়েছে। চাঁদাবাজি বন্ধে দরকার সরকার ও রাজনীতিবিদদের অঙ্গীকার ও প্রচণ্ড সদিচ্ছা।

৫ আগস্ট-পরবর্তী নতুন বাংলাদেশে অর্থনৈতিক গতিশীলতা আনতে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতকে প্রাধান্য দেয়া। বিশেষ করে যেসব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সততার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে, তাদেরকে কীভাবে আরো চাঙ্গা করা যায় সেদিকে নজর দিতে হবে। কেননা সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের উন্নয়ন ঘটলে কর্মসংস্থান বাড়বে। এতে অর্থনীতির আকার বাড়বে, সংকটে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা সহজ হবে।

আমাদের রফতানি আয়ের বড় অংশ আসছে তৈরি পোশাক খাত (আরএমজি) থেকে। রফতানি খাত বৈচিত্র্যময় করতে করণীয় কী?

কুতুবউদ্দিন আহমেদ: আমরা এখন পর্যন্ত গার্মেন্ট শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের রফতানির প্রায় ৮৫ শতাংশ আসে পোশাক খাত থেকে। এ জায়গায় যদি আমরা ভ্যালু অ্যাডিশন বাড়াতে চাই তাহলে বস্ত্র খাতকে আরো জোরদার করতে হবে; তাহলে আমরা আরো বেশি ভ্যালু অ্যাড করতে পারব, যা আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মেটাতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশ থেকে যেসব পণ্য রফতানি হয়ে থাকে সেগুলো সাধারণত নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে। তবে এক্ষেত্রে কিছু কারখানা উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের চাহিদা মেটাতে পোশাক রফতানি করে থাকে, এর পরিমাণ অতি নগণ্য। আমাদের পোশাক কারখানাগুলো ৭০-৮০ শতাংশই ক্যাজুয়াল প্যান্ট, শার্ট, সোয়েটার, টি-শার্ট, পোলো শার্ট ইত্যাদি তৈরি করে থাকে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি পণ্যের ভিন্নতা আনতে পারি, যেমন ফরমাল প্যান্ট, স্যুট, জ্যাকেট, আন্ডারগার্মেন্টস, ব্র্যান্ডেড স্পোর্টসওয়্যার ইত্যাদি পণ্য যদি উচ্চ-মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের জন্য রফতানি করি, তাহলে আমরা আমাদের ভ্যালু অ্যাডিশনও বাড়াতে সক্ষম হব, সেই সঙ্গে বাড়বে রফতানির পরিমাণ। এক্ষেত্রে ভিয়েতনাম হতে পারে একটি বড় উদাহরণ। তারা শুরু করেছিল আমাদের মতো করেই, কিন্তু তারা পরবর্তী সময়ে উত্তরণ ঘটায় হাই ভ্যালু আইটেমে।

আমরা কাঁচামালসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি করছি, এতে আমাদের বড় অংকের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হচ্ছে। আমদানি বিকল্প (ইম্পোর্ট সাবস্টিটিউট) শিল্প গড়ার ক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী হবে?

কুতুবউদ্দিন আহমেদ: এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে যেসব পণ্য আমরা আমদানি করি, সেসব শিল্প যদি দেশে স্থাপন করা যায়, তাহলে আমরা একদিক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় করতে পারব, অন্যদিকে বিপুল পরিমাণে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারব, যা দেশের জিডিপিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে। এছাড়া এর মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (এসএমই) তৈরি করা সম্ভব হবে। এতে করে যেমন নতুন উদ্যোক্তাদের উঠে আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে, সেই সঙ্গে বিদ্যমান ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও তাদের ব্যবসা বাড়ানোর সুযোগ পাবেন।

আমদানি বিকল্প শিল্প বা ইম্পোর্ট সাবস্টিউট ইন্ডাস্ট্রি প্রতিষ্ঠা করলে আমাদের ফরেন কারেন্সি রিজার্ভ বৃদ্ধি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে আমরা কোন কোন পণ্য আমদানি করি তার তালিকা তৈরি করতে পারি। পাশাপাশি সেগুলোর বার্ষিক মূল্যের পরিমাণ পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে কোন কোন পণ্যকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে শুরু করা যায়।

উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি, স্পেয়ার পার্টস আমদানিতে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয়। একটু উদ্যোগ নিলে দেশেই অনেক স্পেয়ার পার্টস বানানো যাবে। গাজীপুরের ‘বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি’-কে যদি আপগ্রেড করা যায় তাহলে নতুন নতুন যন্ত্রাংশ বানানো সম্ভব এবং এটি করার জন্য অবকাঠামো তৈরি আছে। এছাড়া যদি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের বিশেষ সহায়তা দেয়া সম্ভব হয়, তাহলে তারাও সেক্ষেত্রে যন্ত্রাংশ তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারবে।

আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম প্রধান খাত রেমিট্যান্স। রেমিট্যান্স বৃদ্ধিতে করণীয় কী?

কুতুবউদ্দিন আহমেদ: রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে আমরা তিন রকমের রেট দেখতে পাই—১. সরকারি রেট ২. প্রণোদনাসহ সরকারি রেট—শুধু প্রবাসীদের জন্য এবং ৩. কার্ব মার্কেটের রেট। তিনটি রেটই প্রচলিত। ইনসেনটিভ দেয়ার পর যে রেটটি পাওয়া যায় তার থেকে কার্ব মার্কেটের রেট যদি বেশি হয় তাহলে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানোর প্রবণতা থাকবেই। হুন্ডিতে সবসময়ই ঝুঁকি থাকে। তাই এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংক বা এনবিআরের একটা সুচিন্তিত পলিসি ঠিক করতে হবে। যেই ব্যাংকগুলোয় মধ্যপ্রাচ্য থেকে আমাদের ফান্ড আসে, ওই জায়গাগুলোয় ব্যাংকগুলোর মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে, তারা যদি সেখানে তাদের উপস্থিতি ও সম্পৃক্ততা বাড়ায় তাহলে রেমিট্যান্স যোদ্ধারা কোনো ঝুঁকি ছাড়াই অফিশিয়াল চ্যানেলে টাকা পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হবেন।

ব্যবসা-বাণিজ্যে বৈদেশিক বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। যদিও বর্তমানে এর প্রবাহ কম। বৈদেশিক বিনিয়োগ বৃদ্ধিকল্পে সরকারের প্রতি কোনো সুপারিশ রয়েছে?

কুতুবউদ্দিন আহমেদ: দেশের বিনিয়োগ নীতিতে বারবার পরিবর্তনের কারণে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা যেন অনিশ্চয়তার মুখোমুখি না হন, সে ব্যাপারে সরকারের উচিত প্রাথমিকভাবে প্রদত্ত প্রণোদনাগুলোর সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি যেটি প্রয়োজন সেটি হলো বিদেশী যারা এরই মধ্যে বিনিয়োগ করছেন আমাদের দেশীয় খাতগুলোয়, তাদের সঙ্গেই বিস্তারিত সংলাপে অংশ নিয়ে তাদের চাহিদাগুলো শোনা, যেন নীতিমালার যথাযথ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তাদের বিনিয়োগের রাস্তাকে আরো সহজ করে তোলা যায়। এক্ষেত্রে ভারত, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশের উদাহরণ পর্যালোচনা করা যেতে পারে। সেসব দেশে বিদেশী বিনিয়োগ করা সহজতর। বিদেশী বিনিয়োগকারীদের একটি দীর্ঘদিনের দাবি হলো নিয়ন্ত্রক কাঠামোকে সহজীকরণ, প্রশাসনিক প্রক্রিয়াগুলো সরলীকরণ এবং একক সেবা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা। সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগ সমর্থনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোয় ই-গভর্ন্যান্স সিস্টেম দক্ষ ও দ্রুত হওয়া জরুরি। বাংলাদেশের উচিত উত্তর আমেরিকা ও ইউরোপের ব্যবসায়িক সহযোগীদের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে (এফটিএ) অংশ নেয়া, যা পরবর্তী সময়ে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের (এফডিআই) প্রবাহ বাড়াবে। পাশাপাশি দেশীয় এবং বহির্মুখী টেক্সটাইল-পোশাক শিল্পের প্রসারের জন্য গৃহীত উদ্যোগগুলোকে আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে উৎসাহিত করা দরকার।

বণিক বার্তা’র সৌজন্যে 

Related News