তিন সঞ্চালন লাইনের কমে উৎপাদনে যেতে পারবে না রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র

, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2024-10-30 10:06:30

কমপক্ষে ৩টি সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত না হলে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাণিজ্যিক উৎপাদনে যেতে পারবে না। রাশান প্রকৌশলীদের পক্ষ থেকেই এমন শর্তই জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত মাত্র ২টি সঞ্চালন লাইন প্রস্তুত হয়েছে, তৃতীয় লাইনটি আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে প্রস্তুত হবে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ এ প্রথম ইউনিট থেকে ১২০০ মেগাওয়াট, ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট (১২০০ মেগাওয়াট) উৎপাদন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উপকেন্দ্র ও সঞ্চালন প্রস্তুত না হওয়ায় উৎপাদনের তারিখ পিছিয়ে চলতি বছরের ডিসেম্বর করা হয়েছিল। কিন্তু মার্চের আগে উৎপাদনে যেতে পারছে না রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য পৃথক ৫টি সঞ্চালন লাইন তৈরি করা হয়েছে। এগুলো হচ্ছে রূপপুর-বগুড়া, রূপপুর-বাঘাবাড়ি, রূপপুর-গোপালগঞ্জ, রূপপুর-ধামরাই এবং রূপপুর-কালিয়াকৈর। এর মধ্যে রূপপুর-বগুড়া ও রূপপুর-বাঘাবাড়ি প্রস্তুত হয়েছে। অন্য ৩টি লাইনের মধ্যে রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইনের কাজ আগামী ফেব্রুয়ারিতে শেষ হওয়ার কথা। সে কারণে মার্চে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করার কথা বলা হচ্ছে বলে বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র জানিয়েছে।

রূপপুর-গোপালগঞ্জ লাইনের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯২ শতাংশ। শুধু পদ্মা নদী পারাপার অবশিষ্ট রয়েছে। অন্যদিকে রূপপুর-ধামরাই এবং রূপপুর-কালিয়াকৈর লাইনের কাজও শেষ, অবশিষ্ট রয়েছে নদী পারাপারের কাজ। লাইনগুলো ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ প্রস্তুত হবে। রূপপুর-ধামরাই লাইনের সার্বিক অগ্রগতি ৬৯ শতাংশ, যমুনা পার হয়ে মানিকগঞ্জ জেলায় প্রবেশ করা লাইনটি ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বরে প্রস্তুত হবে। রূপপুর-কালিয়াকৈর লাইনের কাজেও যমুনা নদী পারাপারের কাজ অবশিষ্ট রয়েছে।

বিগত সরকারের সময়ে রূপপুর বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ এক বছর পিছিয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর নির্ধারণ করা হয়। আর দ্বিতীয় ইউনিট ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে উৎপাদনে আসার কথা। কিন্তু লাইন নির্মাণ শেষ না হওয়ায় ২০২৪ সালে উৎপাদনে আসতে পারছে না।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৩ এ প্রথম ইউনিট থেকে উৎপাদন শুরু হওয়ার কথা ছিল। রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার কারণে জার্মান প্রতিষ্ঠান সিমেন্স কাজকে জটিল করে তোলে। সিমেন্স ২৩৩/৪০০ কেভি জিআইএস সাব স্টেশন সরবরাহ করার কথা ছিল। শেষ সময়ে সাব স্টেশন সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানালে নতুন ঠিকাদার নিযুক্ত করা হয় চীনা কোম্পানিকে।

অন্যদিকে সঞ্চালন লাইন নির্মাণের তদারক প্রতিষ্ঠান পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় উভয় পক্ষ বসে বাণিজ্যিক উৎপাদনের তারিখ পিছিয়ে দেওয়া হয়।

পিজিসিবি সূত্র জানিয়েছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সঞ্চালন লাইনের দৈর্ঘ্য ৬৬৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে ৪৬৪ কিলোমিটার ৪০০ কেভি সঞ্চালন লাইন ও ২০৫ কিলোমিটার ২৩০ কেভি সঞ্চালন লাইন। ২০ কিলোমিটার রয়েছে নদী পারাপার। এর মধ্যে ৪০০ কেভি ১৩ কিলোমিটার ও ৭ কিলোমিটার ২৩০ কেভি লাইন। পদ্মা ও যমুনার মতো বড় নদী পারাপার রয়েছে। যে কাজটি বেশ জটিল এবং সময় সাপেক্ষ। নদী পারাপার কাজে অর্থায়ন করা হচ্ছে দেশীয় তহবিল থেকে। ডলার সংক্রান্ত জটিলতায় ঠিকাদারকে যথা সময়ে অর্থ দিতে না পারায় কাজটি বিলম্বিত হয়েছে। ফলে প্রকল্পের অন্যান্য কাজ শেষ হলেও নদী পারাপারের কাজ শেষ হতে বেশি সময় লাগছে।

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ব্যয়বহুল এ প্রকল্পে সিংহভাগ অর্থায়ন দিয়েছে রাশিয়া। ১ লাখ ১৩ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্পে রাশিয়ার অর্থায়ন রয়েছে ৯৩ হাজার কোটি টাকা। পরমাণু বিদ্যুতে সবচেয়ে সুবিধার দিক হচ্ছে ৬০ বছর এর দর ওঠানামা করবে না। একই দরে ৬০ বছর নিরবিচচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।

অন্যদিকে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ, গ্যাস এবং তেল ভিত্তিক বিদ্যুতের দর ওঠানামা করে। তুলনামূলক সাশ্রয়ী এবং পরিবেশবান্ধব হিসেবে পরিচিত পারমাণবিক বিদ্যুৎ। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি উৎপাদনে গেলে তেল ভিত্তিক ব্যয়বহুল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দিতে চায় বাংলাদেশ। এতে করে গড় বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ কমে আসবে বলে মনে করছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড। তবে ঝুঁকির বিষয় হচ্ছে পরমাণু বিদ্যুতের উপযোগী লাইন তৈরি করা এবং চাহিদা ও উৎপাদনের সঙ্গে ভারসম্য নিশ্চিত করা।

পৃথিবীর ৩০টি দেশে ৪৪৯টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে। সেগুলো থেকে উৎপন্ন বিদ্যুতের পরিমাণ মোট উৎপন্ন বিদ্যুতের প্রায় ১২ শতাংশ। ১৪টি দেশে আরও ৬৫টি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ২৭টি দেশে ১৭৩টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রক্রিয়া চলমান। এগুলোর মধ্যে ৩০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রই নির্মিত হচ্ছে পরমাণু বিশ্বে নবাগত দেশসমূহে, যার মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে।

Related News