অফসোর পিএসসির (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি) আদলে পার্বত্য এলাকায় তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্রের প্রস্তুতি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা। মার্চ নাগাদ আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বানের কথা জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বার্তা২৪.কমকে বলেন, অফসোর পিএসসির আদলে অনসোর পিএসসির খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। খসড়া চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে কনসালটেন্ট নিয়োগের প্রক্রিয়া চলমান। আমরা আশা করছি সব প্রক্রিয়া ফেব্রুয়ারি মাসের মধ্যেই শেষ করতে পারবো। আর মার্চে দরপত্র আহ্বান করতে চাই। প্রচুর গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকলেও পার্বত্য এলাকায় এখন পর্যন্ত কোন কাজ হয়নি। আমরা আশা করছি সেখানে অনেক গ্যাসের মজুদ রয়েছে।
গ্যাসের দর কেমন হতে পারে এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, দাম এখনই চূড়ান্ত হয়নি। কনসালটেন্ট মতামত দিবে তারপর বলা যাবে, তবে অবশ্যই সাগরের চেয়ে কম হবে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, মডেল পিএসসি-২০১৯ থেকে গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ অনেক ছাড় দিয়ে পিএসসি-২০২৩ চূড়ান্ত করা হয়েছে। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ দরের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রডের দাম ৮০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ৮ ডলার। আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল। দামের পাশাপাশি সরকারের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মডেল পিএসসি-২০১৯ অনুযায়ী গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের অনুপাত বৃদ্ধি পেতে থাকে। আর কমতে থাকে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার। গভীর সমুদ্রে ৫০ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের হিস্যা ৫০ থেকে ৮০ শতাংশ পর্যন্ত উঠানামা করবে। তার আলোকে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
ওই পিএসসির আদলে অনসোর ব্লক ২২ ও ২২(ক) (পার্বত্য এলাকা) এর দরপত্র চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
বাপেক্স সূত্র জানিয়েছে, অফসোরে গ্যাসের দাম ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ ধরা হলেও অনসোরে ব্রেন্ট ক্রডের ৮ শতাংশ প্রস্তাব করা হয়েছে। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রামের পর্যাপ্ত তথ্য নেই, তেল গ্যাস উত্তোলন করা কঠিন, রাস্তা তৈরি করা, গ্যাস পেলে পাইপলাইনের নির্মাণ ব্যয় বহুল। তাই স্থলভাগের অতীতের পিএসসির তুলনায় দাম কিছুটা বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যমান আইনে বাপেক্স, কিংবা সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির অন্য কোন কোম্পানির সঙ্গে ব্লক চুক্তি করার সুযোগ নেই। চুক্তি করতে পারে শুধু পেট্রোবাংলা। একটি ফর্মুলা করা হয়েছে বাপেক্স বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে জেভি করে প্রস্তাব নিয়ে আসবে, পেট্রোবাংলা অনুমোদন দেবে। এখানে বাপেক্স কোন বিনিয়োগ করবে না, তার বিনিয়োগ হচ্ছে জমি। তেল-গ্যাস পাওয়া গেলে আইওসি পেট্রোবাংলাকে যে শেয়ার দিবে, সেখান থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ পাবে বাপেক্স। এই ফর্মুলা অন্যান্য কোম্পানির জন্যও প্রযোজ্য হবে।
বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলে ১৯১৪ সালে প্রথম কূপ (সীতাকুন্ড) খনন করে বার্মা ওয়েল কোম্পানি। এরপর ১৯২২ সালে পাথারিয়ায় কূপ খনন করে। প্রায় ১২টি কূপ খনন করা হয়েছে, সর্বশেষ কূপ খনন করা হয় হালদায় (১৯৯৮সাল)। এরমধ্যে সেমুতাং ১,২,৩ ও ৪ এ গ্যাস পেলেও বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য নয় বলে জানানো হয়। আর কোন কূপে সামান্য মজুদ আবার হালদা, সেমুতাং-৫ পটিয়াতে গ্যাসের আলামত পাওয়া যায়নি বলে তথ্য পাওয়া গেছে।
বাংলাদেশে প্রচুর গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনার কথা জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। ১৯৮৬ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৯টি আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে তেল-গ্যাস সম্পদের সম্ভাবনা নিরূপণে কাজ করে। কিছু সংস্থা সারাদেশে এবং কিছু সংস্থা বিশেষ এলাকায় অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনা করে। ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ভূতাত্ত্বিক জরিপ (ইউএসজিএস) ও পেট্রোবাংলা, হাইড্রোকার্বন ইউনিট ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টরেট সমীক্ষা পরিচালনা করে। ইউএসজিএস-পেট্রোবাংলার প্রতিবেদনে সর্বনিম্ন ৮ দশমিক ৪, গড় ৩২ দশমিক ১ ও সর্বোচ্চ ৬৫ দশমিক ৭ টিসিএফ (ট্রিলিয়ন কিউবিক ঘনফুট) গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়েছে। অপরদিকে হাইড্রোকার্বন ইউনিট ও নরওয়েজিয়ান পেট্রোলিয়াম ডাইরেক্টরেট সর্বনিম্ন ১৯, গড় ৪২ ও সর্বোচ্চ ৬৪ টিসিএফ গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করেছে।
বাংলাদেশে মোট ২৯টি গ্যাস ফিল্ড আবিষ্কৃত হয়েছে। গত ১৬ নভেম্বর দেশীয় কোম্পানির অধীনে থাকা ১৬টি গ্যাস ফিল্ডের ৭৩টি কূপ দিয়ে ৭৭১ মিলিয়ন ঘনফুট ও বহুজাতিক কোম্পানির অধীনে থাকা ৪টি গ্যাসে ফিল্ডের ৪৩ কূপ দিয়ে ১১৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়। এক সময় ২৮০০ মিলিয়ন পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। মজুদ কমে আসায় অনেক কূপেই উৎপাদন কমে এসেছে। ৫টি গ্যাস ফিল্ড (রূপগঞ্জ, কামতা, ফেনী, ছাতক ও সাঙ্গু) পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। ৩টি গ্যাস ফিল্ড (কুতুবদিয়া, ভোলা, ইলিশা ও জকিগঞ্জ) বন্ধ রয়েছে গ্যাস পাইপলাইন না থাকায়।
বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও এখন তিমিরেই মনে করেন অনেকে। তবে সেই ধারা ভেঙে গতিতে ফিরেছে পেট্রোবাংলা। ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে গ্যাসের মজুদ ও উৎপাদন বৃদ্ধিতে আশার আলো দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশের ভূ-খণ্ডে প্রথম কূপ খনন করা হয় ১৯১১ সালে। ১১২ বছরে অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে কমবেশি ৯৯টি। আর ৩ বছরে ৭০টি অনুসন্ধান কূপ খনন করতে চায় পেট্রোবাংলা। পাশাপাশি সাগরে দরপত্র প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে।