অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ বিনিয়োগের জন্য প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে দাবি করে এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি ও বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেছেন, যারা কোনো দিন বিনিয়োগ করেনি, সম্পদ করেনি, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেনি, তারা জোরজবরদস্তি করে একটা জিনিস চাপিয়ে দিচ্ছে বিনিয়োগকারীদের ওপর। তিনি মনে করেন, সমাজের এই উল্টো পদ্ধতি যতক্ষণ ঠিক না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে না, বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে না, কর্মসংস্থানও বাড়বে না।
একটি জাতীয় দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন শীর্ষ এই ব্যবসায়ী ও রাজনীতিক। বার্তা২৪.কম এর পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারের চুম্বকাংশ প্রকাশিত হল:
সম্প্রতিককালে খাদ্যপণ্যের দাম অনেক বেড়ে গেছে। সেটা কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়? সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা কতটা কার্যকর মনে করছেন?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হলো উৎপাদন ও সরবরাহ। আগে আমরা এক ধরনের রাজনীতি দ্বারা পরিচালিত ছিলাম, যাকে আমি দুর্বৃত্তায়নের রাজনীতি বলতে বাধ্য হচ্ছি। এখন আমরা পরিচালিত হচ্ছি সুধীশাসিত রাজনীতি দ্বারা। একেকজন উপদেষ্টার কথা একেক রকম। তাঁরা কি কোনো দিন কোনো উৎপাদনকাজে বিনিয়োগ করেছেন? আমার মনে হয় না। এ জন্য তাঁরা উৎপাদন ব্যবস্থাপনা বোঝেন না, ব্যবসা-বাণিজ্যও বোঝেন না। তাঁরা সুশিক্ষিত এবং জ্ঞানী-গুণী। অনেক সময় জ্ঞানী-গুণীদের দ্বারা ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু যাঁরা ব্যবসা করছেন, তাঁদের দ্বারা এমন অবস্থা হবে না। ধরেন দেশের ১০০ শতাংশ মানুষের মধ্যে ৯৯ শতাংশই ভোক্তা। তার মধ্যে ৮০ শতাংশ হলো গরিব, মধ্যবিত্ত ও উচ্চমধ্যবিত্ত। তারা কিন্তু এখনকার তুলনায় অনেক বেশি মাত্রায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
দেশের অর্থনীতিতে কী ধরনের সংকট দেখছেন আপনি?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: অর্থনীতি যদি ভালো করতে হয় তাহলে দু-তিনটি জিনিস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সবার আগে দরকার সামাজিক শৃঙ্খলা। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি যদি ঠিক না হয় তাহলে ব্যবসা-বাণিজ্য চালানো অসম্ভব। আর নতুন বিনিয়োগ তো হবেই না। দ্বিতীয়ত হলো ব্যাংকিং খাতের চলমান অস্থিরতা। দীর্ঘদিন ধরে ঋণ বিতরণে নানা অনিয়ম হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক তা দেখেনি। বহু ব্যাংক বিভিন্ন পরিবার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত ছিল। এখন হঠাৎ করে বাংলাদেশ ব্যাংক কঠোর নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। তৃতীয়ত, উচ্চ মূল্যস্ফীতি যা নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। একদিকে কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যাংকগুলোর ওপর, আরেক দিক দিয়ে যদি কঠোর মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হয় তাহলে অস্থিরতা সৃষ্টি হবেই। যখন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের কথা আসে তখন তারা দীর্ঘদিন ধরে সংকুচিত মুদ্রানীতি অনুসরণ করেছে। আবার যখন সরকারের ঋণের বেলায় আসে তখন কিন্তু সংকোচন নেই। সরকার যত ঋণ চেয়েছে দিয়েছে। এই যে ত্রিমুখী একটা সংকট সৃষ্টি হয়েছে ব্যাংকিং খাতে, এটা কঠোর নীতি অনুসরণ করে কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে এখন বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। এর একটি হলো আইন-শৃঙ্খলাজনিত, আরেকটি ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতাজনিত। সবগুলোর মূলেই কিন্তু রাজনীতি।
সরকার বেশ কিছু সংস্কার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এই সংস্কার সফল করতে গেলে করণীয় কী?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: এমন একটি সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে, যেখানে লেজুড়বৃত্তি না করলে ব্যবসা চালাতে পারবেন না, ব্যাংক থেকে ঋণ পাবেন না। রাজনীতিবিদরাই পরিস্থিতি এ অবস্থায় নিয়ে গেছেন। এখন সব দোষ দেওয়া হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ওপর। গত ১৫-২০ বছরে অর্থনীতিকে গিলে ফেলেছে রাজনীতি। অর্থাৎ যাঁরা রাজনীতি করতেন, তাঁরাই আবার ব্যবসা করতেনা। এখন এগুলো তো এত সহজে আপনারা ঠিক করতে পারবেন না। আপনারা সংস্কারের কথা বলছেন। কয়টা সংস্কার করবেন? সাংবিধানিক সংস্কার লাগবে, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার লাগবে। এখন সংবিধান সংস্কার করতে গেলে জনগণকে লাগবে। কিন্তু জনগণের সঙ্গে তো কোনো কাজকারবার দেখছি না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংস্কার করতে পারে। নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার, নির্বাচন প্রক্রিয়ার সংস্কার এবং নির্বাচনে যেন কেউ কারচুপি করতে না পারে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হলে দেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সেই সরকারকে যেন জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়।
সিন্ডিকেট থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: গত ১৫ বছরে রাজনৈতিক সিন্ডিকেট ছিল সবচেয়ে বড়। এই রাজনৈতিক সিন্ডিকেটের আওতায় বিভিন্ন খাতে ছোট ছোট সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এখন যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত, তারাও একটা সিন্ডিকেট। পণ্যের মূল্য নির্ধারণ হয় সরবরাহ ও চাহিদার ওপর ভিত্তি করে। চাহিদা যদি বাড়ে কিংবা চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না থাকে, তাহলে মূল্য বৃদ্ধি পাবে। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে—কিছু কিছু পণ্যের সরবরাহ অল্প কয়েকজন লোকের হাতে নিয়ন্ত্রিত। সেটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু কারওয়ান বাজারে গেলে দেখতে পাবেন, অন্তত ২০০ জন সবজি বিক্রি করছে। ২০০ দোকানদার চিনি বিক্রি করছে। তাহলে ২০০ জন মানুষের সিন্ডিকেট কিভাবে হয়? তার মানে হলো, সিন্ডিকেট হয় ওপরের লেভেলে। সেই সিন্ডিকেটের সঙ্গে রাজনীতি জড়িত। অর্থাৎ যতক্ষণ রাজনীতি ঠিক না হবে, উৎপাদন না বাড়বে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমস্যা বিদ্যমান থাকবে। সংকট আরো বেশি হবে। বর্তমান সরকার যতক্ষণ এই সমস্যা বুঝতে না পারবে এবং উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বিনিয়োগকারীদের সহায়তা না করবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উৎপাদনে ঘাটতি হবে, উৎপাদন ব্যয় আরো বৃদ্ধি পাবে।
ব্যাংক ও আর্থিক খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর রুগ্ণ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় গভর্নর সাহেব বলতে পারবেন। আমরা গভর্নরকে যেভাবে পরামর্শ দিয়েছি, তিনি সেভাবে চলছেন না। তিনি আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে চলছেন। আমি দীর্ঘদিন গভর্নরকে চিনি। তিনি সৎ মানুষ। তবে তিনি যদি বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত না নেন তাহলে দেশের ব্যাংকিং খাতের অবস্থা আরো খারাপ হবে, দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা আরো খারাপ হবে। আমি তাঁর সঙ্গে একাধিকবার কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, সমস্যা আছে, আমরা এই সমস্যা আর বাড়তে দেব না। এ জন্য তিনি সহায়তাও করছেন। কিন্তু যতটুকু সহায়তা করছেন তা যথেষ্ট নয়। দেশের সামাজিক অবস্থা, রাজনৈতিক অবস্থা, অর্থনৈতিক অবস্থা, মানুষের চরিত্র—এসব একত্রে এনে সমস্যার সমাধান করতে হবে। তা না করে আপনি যদি আপনার চরিত্রের সততা দিয়ে সমস্যার সমাধান করতে চান, তাতে দেশের সমস্যা আরো বাড়বে।
শিল্পাঞ্চলের সাম্প্রতিক অস্থিরতা খাতটির অগ্রযাত্রা কতটা ব্যাহত করবে?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যকর উদ্যোগ দেখছি না। তাঁরা চেষ্টা করছেন। আমাদের অনেক সমস্যাও আছে। বেসরকারি খাত এখন মনোবল হারিয়ে ফেলেছে। গত ১৫ বছরে উৎপাদনশীলতা কমতে শুরু করে, গত পাঁচ বছরে তা আরো কমে গেছে। উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ নেই। উল্টো সামাজিক বিশৃঙ্খলা, শ্রমিক অসন্তোষ বেড়ে গেছে। কারখানাগুলোতে হামলা, আন্দোলন চলছে, যার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে অর্থনীতিতে। যেকোনো মূল্যে এই পরিস্থিতির সমাধান দরকার।
উৎপাদনশীলতা কমলে অভ্যন্তরীণ বাজারে কী প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: দেশে শিল্প-কারখানা ঠিকমতো চলছে না। উৎপাদন ঠিকমতো হচ্ছে না। উৎপাদন যদি না হয়, রপ্তানি ছাড়াও আমাদের অভ্যন্তরীণ বাজারের চাহিদা মেটাতে উৎপাদন করতে হয়, দেশের উৎপাদন না বাড়ালে মূল্যস্ফীতি আরো বেড়ে যাবে। কিভাবে সরকার উৎপাদনশীলতা, রপ্তানি বাড়াবে, তার কোনো লক্ষণ দেখছি না।
শিল্প-কারখানায় হামলা, মালিকদের নামে মামলাসহ নানাভাবে হয়রানি করার ফলে অর্থনীতিতে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। এখান থেকে বেরিয়ে আসার উপায় কী?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: রাজনীতি ঠিক না হলে অর্থনীতি ঠিক করতে পারবেন না। ব্যবসায়ীরা সম্পদ সৃষ্টি করে, সেবা করে এবং ব্যবসা করে; করও দেয়। আর যে সম্পদ অর্জন করে, সে করও দেয় না, বিনিয়োগও করে না; সম্পদ রক্ষা করার জন্য বিদেশে পাচার করে। এ গোষ্ঠীটা সবাই এক। যখন নতুন সরকার এসে বলে অর্থ পাচারকারীদের ধরবে, শেষ পর্যন্ত গিয়ে ধরে কিন্তু সম্পদ সৃষ্টিকারীদেরই। যারা দেশে আছে, দেশের উন্নয়নে কাজ করছে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে—সবাই ধরে তাদেরই। যতক্ষণ সমাজে সম্পদ সৃষ্টিকারী ও সম্পদ অর্জনকারীদের আলাদা না করা হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এই সমস্যার সমাধান হবে না। বিনিয়োগকারীদের যদি ধরে নিয়ে যান, নানা রকমের অন্যায়-অবিচার করেন, তাহলে এত সহজে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটবে না। আমাদের দেশে যারা বিনিয়োগ করে, সম্পদ সৃষ্টি করে, কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে—সব দায়দায়িত্ব তাদের ওপর গিয়ে পড়ছে।
চলমান সংস্কার কিভাবে সার্থক করা যায়?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দেশের গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোতে সংস্কারের লক্ষ্যে কমিশন গঠন করেছে। আমরাও সংস্কার চাই। কিন্তু রাজনৈতিক সংস্কারকে সার্থক করতে রাজনৈতিক লোকদের দিয়ে সংস্কার করতে হবে। আমরা আন্দোলন করেছি গণতান্ত্রিক সরকারের জন্য। আশা করি আমাদের সেই স্বপ্ন দ্রুতই পূরণ হবে।
এত বড় একটা অভ্যুত্থানের পরও কি দেশের রাজনীতিতে কোনো পরিবর্তন আসবে না? আপনি কী মনে করেন?
আবদুল আউয়াল মিন্টু: এটা তো এখন বলা যাচ্ছে না। যখন নির্বাচন হবে, একটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসবে, তখন আমরা দেখতে পারব তারা ক্ষমতা কিভাবে ব্যবহার করছে। এটা এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। তবে আমার রাজনৈতিক দল ৩১ দফা উল্লেখ করে সংস্কার করার প্রস্তাব দিয়েছে। তাতে আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমার দল সংস্কার করবে। অন্যদের কথা আমি বলতে পারব না। একটা কথা বলি, যতক্ষণ জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করা না যাবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোনো সংস্কারই টেকসই হবে না। কারণ এখানে কিছু সাংবিধানিক সংস্কার আছে, কিছু আছে প্রাতিষ্ঠানিক, নিয়ন্ত্রণ সংস্থার, পরিদর্শকদলের সংস্কার। এগুলো করতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যখনই সাংবিধানিক ও আইনগত সংস্কার করতে যাবেন, তখনই কিন্তু জনগণের কাছে জবাবদিহির বিষয়টি প্রয়োজন হবে। কারণ এটা না হলে সংস্কারগুলো টেকসই হবে না।