সিএনজির পরিবর্তে নদী পথে এলএনজি আসবে মেঘনাঘাট

, অর্থনীতি

সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2025-01-20 09:14:42

ভোলা থেকে ফিরে: রূপসাতে (খুলনা) নয়, ভোলা থেকে এলএনজি (তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস) আসবে নারায়ণগঞ্জের মেঘনা ঘাটে। ভোলার উদ্বৃত্ত গ্যাস এলএনজি আকারে নদীপথে এনে রিগ্যাসিফিকেশন করে পাইপলাইনের দেওয়ার বিষয়টি অনেকদূর এগিয়েছে বলে জানিয়েছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্র।

প্রথম দিকে রূপসা বিদ্যুৎকেন্দ্রে এলএনজি সরবরাহের আলোচনা সামনে এসেছিল। ভোলার কোন পয়েন্ট থেকে গ্যাস দেওয়া হবে সেটি চূড়ান্ত করার জন্য সরেজমিন পরিদর্শন করেন পেট্রোবাংলার উচ্চ পর্যায়ের একটি টিম। পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপরেশন অ্যান্ড মাইন্স) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ওই টিমের নেতৃত্ব দেন। টিমটি ১৭ জানুয়ারি ভোলা পরিদর্শন করে, বোরহান উদ্দিন ও ভোলা খেয়াঘাট পয়েন্ট থেকে গ্যাস দেওয়ার স্থান প্রাথমিকভাবে চিহ্নিত করেছেন বলে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি সূত্র নিশ্চিত করেছেন।

প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, স্থান নির্ধারণের জন্য একটি কমিটি ছিল, সেই কমিটি মেঘনাঘাট ও ভোলা সদরের বিষয়ে সুপারিশ জমা দিয়েছে। আমরা সেটি সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখেছি।

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যতদ্রুত সম্ভব এলএনজি আনার বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। আমরা সে লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছি। যেহেতু বিষয়টি একেবারে নতুন, আবার দরপত্র ডকুমেন্ট তৈরি করতে হবে পিপিআর অনুযায়ী। সে কারণে কিছুটা সময় লাগছে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমার জানামতে ভোলা থেকে এলএনজি আনার বিষয়ে ৪টি কোম্পানি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব জমা দিয়েছে। তবে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে চূড়ান্ত করা হবে।

সারাদেশে যখন গ্যাস সংকট চরম আকার ধারণ করেছে আমদানি করেও সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। ঠিক সেই সময়েও ব্যবহার না থাকা দ্বীপজেলা ভোলায় উদ্বৃত্ব গ্যাস পড়ে রয়েছে।

ভোলায় দু'টি গ্যাসফিল্ডে মোট ৯টি কূপ খনন করা হয়েছে। যা দিয়ে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। ৯টি কূপের মধ্যে ৫টি এখনই গ্যাস উৎপাদনে সক্ষম রয়েছে যেগুলো থেকে দৈনিক ১৩৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া সম্ভব। কিন্তু সেখানে গ্যাসের চাহিদা না থাকায় মাত্র ৮০ মিলিয়ন গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে বর্তমানে। অপর ৪টি কূপের মধ্যে ১টির পাইপলাইন এবং ৩টি কূপের প্রসেস প্লান্ট রেডি হচ্ছে।

ভোলার গ্যাস পাইপলাইনের মাধ্যমে আনার জন্য বহুদিন ধরেই আলোচনা চলছে। কিন্তু নানান কারণে ভোলা-বরিশাল- খুলনা পাইপলাইনের অগ্রগতি সামান্যই। সবেমাত্র ভোলা-বরিশালের প্রাক সমীক্ষা শেষ হয়েছে। ভোলা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা নিতে গেলে ১৫০ কিলোমিটার পাইপ লাইন দরকার। তাতে প্রায় ৭ থেকে ৮ হাজার কোটি টাকা খরচের প্রাক্কলন করা হয়েছে। ৭ হাজার কোটি টাকার জন্য যখন পাইপলাইন আটকা, তখন এক কার্গো এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হচ্ছে ৬৪৯ কোটি টাকা (আগস্টের দরপত্র)। যা দেশের ১ দিনের চাহিদার (৩০০০ মিলিয়ন) সমান।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকার পাইপলাইনের পরিবর্তে সিএনজি আকারে আনার জন্য বেশি জোর দেয়। ভোলার উদ্বৃত গ্যাস সিএনজি আকারে আনতে ২০২৪ বছরের ২১ মে ইন্ট্রাকো রিফুলিং স্টেশন পিএলসির সঙ্গে প্রথমে ৫ মিলিয়ন ও দ্বিতীয় ধাপে আরও ২০ মিলিয়ন গ্যাস সিএনজি আকারে সরবরাহের চুক্তি করে সরকার।

প্রথম ধাপের চুক্তি অনুযায়ী দৈনিক সর্বোচ্চ ৩ মিলিয়ন সরবরাহ দিয়েছে কোম্পানিটি। যা গড়ে দেড় থেকে দুই মিলিয়ন গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জের ১৮টি শিল্পকারখানায় সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে প্রতি ঘনমিটারে পরিবহন খরচ ৩০.৬০ টাকাসহ গ্যাসের দাম দাঁড়াচ্ছে ৪৭.৬০ টাকা। যা পাইপলাইনে সরবরাহ করা গ্যাসের তুলনায় দেড়গুণের মতো। দ্বিতীয় ধাপের ২০ মিলিয়ন যথাসময়ে (অক্টোবর ২০২৪) সরবরাহ দিতে ব্যর্থ হয় কোম্পানিটি। যে কারণে চুক্তি বাতিল করার চিঠি দিয়েছে সুন্দরবন গ্যাস কোম্পানি।

এলএনজি আমদানি বাড়িয়ে সামাল দেওয়াকে বিপদজনক বিকল্প হিসেবে মনে করছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। আকাশচুম্বি দাম যেমন বাঁধা, তেমনি চাইলেই ইচ্ছামতো আমদানির পরিমাণ বাড়ানো সুযোগ নেই। দুটি এফএসআরইউ দিয়ে দৈনিক সর্বোচ্চ ৯০০ মিলিয়ন আমদানি করা সম্ভব। নতুন এফএসআরইউ করতে গেলে দরপত্র চূড়ান্ত করার পর কমপক্ষে ১৮ মাস লাগবে। অর্থাৎ ২০২৬ সাল পর্যন্ত এলএনজি আমদানি বাড়ানোর কোনো পথ খোলা নেই, দামের ইস্যু বাদ দিলেও।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড থেকে ১ টাকা দরে, বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি থেকে ১.২৫ টাকা দরে, বাপেক্স থেকে ৪ টাকা দরে প্রতি ঘনফুট গ্যাস কেনা হয়। এরপর বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও টাল্লোর কাছ থেকে কেনা গ্যাসের সংমিশ্রণে গড় দর দাঁড়ায় ৬.০৭ টাকা ঘনমিটার। আর প্রতি ঘনমিটার এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫.৭০ টাকা (আগস্ট ২০২৪)। ভ্যাট-ট্যাক্স ও অন্যান্য চার্জ যোগ করলে দাঁড়ায় ৭৫.৭২ টাকা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে হলে গ্যাসের প্রাইস গ্যাপ কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা ঘাটতি হবে বলে মনে করছে পেট্রোবাংলা। যে কারণে তারা শিল্প ও ক্যাপটিভে ১৫২ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করেছে।

যখন এক-চতুর্থাংশ আমদানি করতে ত্রাহী অবস্থা, সেই সময়ে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর মজুদ ফুরিয়ে আসছে, এতে প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে উৎপাদন। এক সময় দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলো থেকে দৈনিক ২৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পাওয়া যেতো ১৮ জানুয়ারি ১৯২৮ মিলিয়ন ঘনফুটে নেমে এসেছে।

পেট্রোবাংলা সূত্র জানিয়েছে, সিএনজির আকারে আনার যে চুক্তি রয়েছে এর বাইরে আরও দৈনিক ২৫ মিলিয়ন গ্যাস এলএনজি আকারে আনার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রাকৃতিক গ্যাসকে শীতলকরণ প্রযুক্তির মাধ্যমে তাপমাত্রা কমিয়ে মাইনাস ১৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে নামিয়ে আনলে তরলে পরিণত হয়। এই তরল প্রাকৃতিক গ্যাসকেই এলএনজি বলা হয়। যখন প্রাকৃতিক গ্যাসকে সাধারণ বায়ুমন্ডলীয় চাপে তরল করে ফেলা হয় তখন এর আয়তন কমে যায় প্রায় ৬০০ গুণ। অর্থাৎ ৬০০ লিটার গ্যাসকে এলএনজিতে রূপান্তরিত করে মাত্র এক লিটারের ছোট্ট একটা বোতলে ভরে ফেলা যায়। পরিবহনের সুবিধার জন্য এলএনজি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় কাতার এবং ওমান থেকে আমদানি করা হচ্ছে। যা বাংলাদেশে আনার পর আবার রিগ্যাসিফিকেশন করে লাইনে সরবরাহ করা হয়।

পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী দেশে ৮টি গ্রাহক শ্রেণিতে অনুমোদিত লোডের পরিমাণ রয়েছে ৫ হাজার ৩৫৬ মিলিয়ন ঘনফুট (দৈনিক)। এর বিপরীতে চাহিদা ধারণা করা হয় ৩ হাজার ৮০০ থেকে ৪ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। চাহিদার বিপরীতে দৈনিক ২ হাজার ৮০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে, আর ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১ হাজার ২০০ মিলিয়নের মতো। অন্যদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড়ে ২ হাজার ৪৯৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ দেওয়া হয়েছে।

Related News