বন্যার কবলে মারাত্মক বিপর্যস্ত লক্ষ্মীপুরের জনজীবন। বিপদকালীন এই সময়ে পানি থেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে মানুষ নিজেরা যেমন বিপাকে পড়েছেন, তেমনি বিপাকে রয়েছেন গৃহপালিত গবাদি পশু-পাখি নিয়ে। তাই নিজেদের সাথে করেই আশ্রয়কেন্দ্র কিংবা দূর-দূরান্তে স্বজনদের বাড়িতেও এসব পশু-পাখীদের সঙ্গে নিয়ে নিরাপদ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা। কেউ কেউ অপরিচিত এলাকাবাসীর থেকে একটু জায়গা চেয়ে নিয়ে সেখানেই উঠিয়েছেন নিজেদের গবাদি পশু, হাঁস-মুরগি।
তবে কোনো রকম আশ্রয়ের জায়গা করে নিলেও সেসব গবাদি পশু ও পাখিদের খাবার সরবরাহে ব্যাপক সমস্যার কবলে পড়েছেন তারা। কারণ নিজ বাড়িতে সংগ্রহে রাখা খড়-ঘাস কিংবা দানাদার খাবারের কিছুই সঙ্গে আনা সম্ভব হয়নি।
সদর উপজেলার পূর্ব দিঘলী ভূইয়া বাড়ির গৃহস্থ হেলাল উদ্দিন। তার ৬টা গরু। তিনি তার পরিবার পরিজনসহ গরুগুলো নিয়ে উঠেছেন অদূরে দিঘলী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়েরা অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে।
একইভাবে আরেক প্রতিবেশী সিরাজ মিয়া তিনিও একই কেন্দ্রে ৭টি গরু নিয়ে উঠেছেন। আরেকজন ফরিদা বেগম তিনি ২টা ছাগল নিয়ে উঠেছেন ওই কেন্দ্রে।
সরেজমিনে মঙ্গলবার (২৮ আগস্ট) দুপুরে মান্দারী-দিঘলী পাকা সড়কের পাশে একতলা দুইটি ভবনের ওই কেন্দ্রে দেখা যায়, কেন্দ্রের মাঠসহ তিনপাশে থৈ থৈ পানি। ভেতরে ৬টি কক্ষে নারী-শিশু সহ ৬টি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। আর দুইটি বারান্দায় ১৩টি গরু, ২টি ছাগল,পৃথক খাঁচায় অনেকগুলো হাঁস-মুরগী। সাথে সামান্য কিছু খড়কুটো। বারান্দার এককোনে চলছে রান্নাসহ গৃহস্থালী কাজ। আর বাকি বারান্দায় গবাদি পশু-পাখির বসবাস। এক ছাদের নিচে মানুষে আর পশু-পাখিতে মিলেমিশে ঠাসাঠাসি যাপিত জীবনের এ এক করুণ চিত্র।
সেইখানে জানতে চাইলে হেলাল উদ্দিন বলেন, বুক পরিমান পানি বাড়ির উঠানে। বসত ঘরের অর্ধেক পানির তলে। গোয়াল ঘরতো ভেঙেই পড়েছে। নিজেরা না হয় কোনো মতে খেয়ে না খেয়ে স্বজনদের বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিতাম। কিন্তু গরুগুলো নিয়ে পড়েছি বিপদে। তাই এখানে পরিবারসহ গরুগুলোকে নিয়ে উঠেছি।
সিরাজ মিয়া বলেন, আমার ১৩টি গরু। ৭ টি এখানে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠাতে পেরেছি। বাকি ৬টি অন্য একজনের বাড়ির উঠেনে রেখে এসেছি। গরুগুলোর খড়-ঘাস সহ খাবারের মারাত্মক সংকটে পড়েছেন বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, পাশের বাজার থেকে আধা কেজি করে খৈল কিনে এনে সামান্য কিছু ভিজা খড়ের সাথে মিশিয়ে গরুকে খেতে দেই। এভাবে আর বেশি দিনও চলা যাবে না। এদিকে গরুগুলো অনাহারে আর পানির কারণে অসুস্থ হয়ে উঠছে। প্রাণি সম্পদের কারও সাথে যোগাযোগও করতে পারছি না। গরুগুলোর কোনো চিকিৎসা করাতেও পারছি না।
এদিকে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রাণি সম্পদ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, লক্ষ্মীপুরের ৫টি উপজেলার ১৩ হাজার ৭০০ একর চারণ ভূমি প্লাবিত হয়েছে।
বন্যায় ক্ষতির শিকার হয়েছে ২২ হাজার ৪১৩টি গরু, ২ হাজার ৮৮৯টি মহিষ, ১৩ হাজার ৪১৯টি ছাগল, ৯৬০টি ভেড়া, ২১ হাজার ৭৮৫টি হাঁস ও প্রায় ৪ কোটি ২০ হাজার মুরগী।
এছাড়া ১০৮টি খামারের ৪৪৫টি গরু, ১৯০টি হাঁস-মুরগীর খামারের ৩ লাখ ৩৬ হাজার হাঁস-মুরগী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ১৮টি গরু, ৫২ টি ছাগল ও ১৫টি ভেড়া, ১ লাখ ৫১ হাজার মুরগী ও ৯৭৩টি হাঁস মারা গিয়েছে।
তিনি জানান, সব মিলিয়ে গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগীতে মোট ৬ কোটি ৪১ লাখ ৫৮ হাজার ৫'শ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
এছাড়াও ২ কোটি ৮৬ লাখ ৭ হাজার ৫ 'শ টাকার খড়, ৭ কোটি ৭১ হাজার ২০০ টাকার দানাদার খাদ্য, ৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা মূল্যের ঘাস বিনষ্ট হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বিভিন্নভাবে এ যাবৎ চিকিৎসা দেয়া হয়েছে ১০ হাজার ৯৭৩ হাঁস-মুরগী ও ৪১৩ গবাদি পশুকে চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ কুমুধ রঞ্জন মিত্র বলেন, প্রথমদিকে কিছুটা ঝুঁকি ছিল। আমরা সার্বক্ষণিক মনিটর করেছি। আপাতত গবাদিপশুর তেমন কোনো ঝুঁকি নেই। আমরা উপজেলা কর্মকর্তাদের মাধ্যমে খোঁজ খবর রাখছি নিয়মিত। তবে কিছুটা সংকট রয়েছে গো খাদ্যের। এ অবস্থায় প্রত্যেক উপজেলায় ১ লাখ টাকা করে বরাদ্দ বিতরণ করা হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির তালিকা পাঠানো হয়েছে। আরও বরাদ্দ আসবে সহসাই। এলে চাষী ও খামারিদের মাঝে বিতরণ করা হবে।