ফেনী থেকে: বাঁধ ভেঙে পানি আসা শুরু হলো, তখন রাত ৩টা। পানির স্রোত শুরু হলো। ঘরে স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোন আর আমার বাবা ছিল। কী করব, কোথায় যাব দিশা না পেয়ে সব রেখে দৌড়ে বের হই। মুহূর্তেই আমার ঘরের ভিটাসহ পানিতে ভেসে যায়। ঘরে গোলার ধান ছিল, সব আসবাবপত্র, ছেলে মেয়েদের বইখাতা, নগদ কিছু টাকা ছিল। কিন্তু এসে দেখি কিছু নাই। ভিটার মাটিটাও নিয়া গেছে স্রোত।
বন্যাকালীন এমন বিভীষিকাময় মুহূর্তের স্মৃতিচারণ করছিলেন ফেনীর ফুলগাজী উপজেলার দরবারপুর ইউনিয়নের জগৎপুর গ্রামের দুলা মিয়া হাজী বাড়ির কবির আহমেদের ছেলে মোবারক হোসেন।
দুই ভাই, স্ত্রী সন্তান, ভাইদের স্ত্রী সন্তান, বাবা নিয়ে এক বাড়িতেই থাকতেন তিনি। ২০১৪ সালে বাড়িটি বানিয়েছিলেন ৩ ভাই মিলে। গত ১০ বছরে তিলে তিলে গড়েছেন সংসারের সবটুকু, যা ভেসে গেছে বানের স্রোতে। সব হারিয়ে এখন নিঃস্ব মোবারক হোসেন ও তার ভাইরা। আশ্রয় নিয়েছেন পাশের বাড়ির একটি ঘরে।
মোবারক হোসেন বলেন, ৪টা ঘর ৪টা-ই ভেসে গেছে। কিছু নেই, যা দিয়ে ঘুরে দাঁড়াবো। এখানে যে বাড়ি ছিল তারও কোনো অস্তিত্ব নেই৷ ঘরে মাটিও নেই। আশেপাশে সব জায়গায় একই অবস্থা। কোথা থেকে মাটি এনে জায়গা করব?
একদিকে যেমন বিলীন হয়েছে মোবারক হোসেনের ঘর-বাড়ির ও গোলার ধান-চাল। অন্যদিকে তার বর্গা করে চাষ করা সব ফসলি জমির ফসলও নষ্ট হয়ে গেছে।
মোবারক জানান, নিজের ও অন্যের জমি মিলিয়ে ৪৫ হাজার টাকা খরচ করে চাষাবাদ করেছেন তিনি। ধানচাষের টাকা দিয়ে এবার পাকাবাড়ি বানানোর স্বপ্ন ছিল মোবারকের। তবে এখন মাথা গোজার ঠাঁইও নেই।
তিনি বলেন, ৫০ মণ ধান ছিল কিছুই বাঁচাতে পারলাম না। একবেলা যে রান্না করে খাব সে উপায়ও নেই। ঘরের অন্যান্য আসবাবপত্র নষ্ট তো হয়েছেই, পাশাপাশি আমার সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। বর্গা নেয়া জমির সব ধান নষ্ট। এখন চাষাবাদের টাকার ভাগ তো দিবে না বর্গা মালিক। ৩ কানি জমির অবস্থাও ভালো না। পলি জমে গেছে। কাদা হাঁটু সমান।
এদিকে সন্তানদের ভিটামাটির এমন দৃশ্য মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন মোবারকের বাবা কবির আহমেদ। তিনি বলেন, ৩ দিন খাই না। মুড়ি খেয়ে আছি। রাস্তা ভাঙা কেউ খাবার নিয়েও আসে না এদিকে। আমার ছেলেগুলা পথে বসল। ছোট ছেলের ২০ মণ ধান বড় ছেলের ৫০ মণ সব ভেসে গেছে৷ কিছু নাই। আমাদের সহযোগিতা করেন। অন্তত ঘরগুলো বানায় দেন।
মোবারক হোসেনের মত লক্ষাধিক মানুষের ঘরবাড়ি বিলীন হয়েছে এবারের ভয়াবহ বন্যায়৷ ফলে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসন ছাড়া এসব মানুষের অস্তিত্ব টিকে রাখা অসম্ভব বলে মনে করছেন অনেকে। এতে সরকারি উদ্যোগে পুনর্বাসনের জন্য বড় প্রকল্প নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
এ বিষয়ে ফেনী জেলা প্রশাসক মুছাম্মাৎ শাহীনা আক্তার বলেন, পুরো ফেনী জেলা জুড়ে বন্যার ক্ষত দৃশ্যমান হচ্ছে। আমরা কাজ করছি। ক্ষয়ক্ষতির নিরূপণের পর আমরা ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুর্যোগ মন্ত্রণালয়ে তালিকা প্রেরণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।