ময়মনসিংহে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি, দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি

, জাতীয়

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ময়মনসিংহ | 2024-10-06 20:12:18

অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া ও ফুলপুর উপজেলার বন্যা পরিস্থিতি অবনতি দেখা দিয়েছে। প্লাবিত হয়েছে নতুন নতুন এলাকা। তিন উপজেলার ২১ ইউনিয়নের দেড় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিন উপজেলাতেই বিদ্যুৎ সংযোগ এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক নেই। এতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে বিপাকে পড়েছেন মানুষজন। অতিবৃষ্টিতে জেলাজুড়ে মৎসখাতে ৫ হাজার ৯৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।

রোববার (৬ অক্টোবর) বিকেলে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন, জেলা ত্রাণ ও দুর্যোগ পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. সানোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, উপজেলার প্রাথমিক বিদ্যালয়, মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোকে আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে এখন নারী শিশুসহ দেড় সহস্রাধিক মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। তিন উপজেলায় ৩০ মেট্রিক টন খাদ্য সহায়তা দেয়া হয়েছে। দুর্গতদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম চলছে। এছাড়া রান্না করা খাবারও দেয়া হচ্ছে বন্যা দুর্গতদের। তবে, এখন পর্যন্ত কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।


স্থানীয় সুত্র জানায়, ধোবাউড়া বন্যা দুর্গতদের মাঝে শুকনো খাবার ও বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট দেখা দিয়েছে। তাদের খাবারের ব্যবস্থা করছেন প্রশাসন। এছাড়াও নেতাই নদীর আশপাশের এলাকায় অন্তত অর্ধশত ঘরবাড়ি বিলীন হয়ে গেছে। পানিবন্দি অনেকে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছে। উপজেলার কলসিন্দুর, জিগাতলা, পঞ্চনন্দপুরসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নেতাই নদীর বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। এতে পুরো উপজেলা প্লাবিত হয়েছে।

ফুলপুর উপজেলার ছনধরা, রামভদ্রপুর, সিংহেশ্বও, ফুলপুর ইউনিয়নের অধিকাংশ ও অন্যান্য ইউনিয়নের আংশিক এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। এসব এলাকার আমন ফসল ও সবাজি খেত তলিয়ে গেছে। ভেসে গেছে মাছের খামার। উপজেলা সদর থেকে কলসিন্দুর পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও ধোবাউড়া পাকা রাস্তা, ঘোষগাঁও বালিগাঁও পাকা রাস্তা, মুন্সিরহাট বাজার থেকে শালকোনা পাকা রাস্তা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে।

এদিকে হালুয়াঘাটের প্রায় সব ইউনিয়ন প্লাবিত হয়েছে। তলিয়ে গেছে হাজার হাজার হেক্টর জমির ধান, সবজি খেত ও ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দি হয়ে আছে হাজার হাজার মানুষ। ঘরের মধ্যে পানি ঢোকার কারণে রান্নার কাজও ব্যাহত হচ্ছে। অনাহারে-অর্ধাহারে দিনাতিপাত করছে তারা।


জেলা কৃষি অফিস সুত্র জানায়, জেলার ধোবাউড়া উপজেলায় নিমজ্জিত ধান ১১ হাজার ৭০০ হেক্টর, সম্পুর্ণ নিমজ্জিত ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ৪ হাজার ২০০ হেক্টর ও সবজি ৬০ হেক্টর। হালুয়াঘাটে নিমজ্জিত ধান ৭ হাজার ৬০০ হেক্টর, সম্পূর্ণ নিমজ্জিত ৪ হাজার ১০০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ৩ হাজার ৫০০ হেক্টর ও সবজি ৭৫ হেক্টর। ফুলপুরে নিমজ্জিত ধান ৩ হাজার ৬৩০ হেক্টর, সম্পুর্ণ নিমজ্জিত ১ হাজার ৪৮০ হেক্টর, আংশিক নিমজ্জিত ২ হাজার ১৫০ হেক্টর ও সবজি ৬২ হেক্টর।

আমতৈল গ্রামের সিদ্দিক মিয়া বলেন, রাস্তাঘাটে পানি, ঘরে, রান্না ঘরে পানি। কোথায় কোন শুকনা খাবার পেলাম না। তাই খালি হাতেই ফিরতে হয়েছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন।

কৈচাপুর গ্রামের বাসিন্দা আবুল কাশেম বলেন, এমন বন্যা আগে কখনও দেখি নাই। ১৯৮৮ সালের বন্যা দেখেছি, এমন পানি ছিল না। বাড়ি ঘরে পানি উঠেছে। গরু ছাগল নিয়ে বিপদে আছি। গরু পানির মধ্যে বাধাঁ। আমরা খুব সমস্যা আছি। চলাফেরা খুব সমস্যা, রাস্তায় বুক সমান পানি। ফসলের অনেক ক্ষয় ক্ষতি হয়ছে। আমন ধান পানির নিচে পড়ে গেছে। এবার আমন ধান পাবো, এমন আশা করা যায় না। অনেক শাকসবজী জমি তলিয়ে গেছে।


বন্যাদুর্গত এলাকা পরিদর্শন শেষে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, সিমান্তবর্তী হালুয়াঘাট, ধোবাউড়া, নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতি এসব এলাকায় পাহাড়ি ঢল এবং অতিবৃষ্টির কারণে যেমন প্লাবিত হয়েছে, এরকম পানি বিগত ১৫-২০ বছরে আমরা দেখেনি। এখানে রাস্তা ঘাট, ব্রীজ, কালভার্ট, মানুষের বাড়ী ঘর, জমির ফসল গরু ছাগল, হাঁস মুরগী সব নষ্ট হয়ে গেছে। এমন একটা পরিস্থিতির জন্য আমরা কেউ প্রস্তুত ছিলাম না। হঠাৎ করেই পাহাড়ি ঢল ও বন্যায় বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছি, এখানে পর্যাপ্ত ত্রাণ দেওয়ার জন্য। আজকে এখানে বিভাগীয় কমিশনার এসেছিলেন, উনার সাথে কথা বলেছি এবং অন্যান্য প্রশাসনের লোকজনের সাথে কথা বলেছি। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছে পর্যাপ্ত ত্রাণ তারা দিবেন। আমরা নিজেদের যা সামর্থ্য আছে সেটা নিয়ে জনগনের পাশে আমরা দাঁড়াচ্ছি। আমরা প্রথম দিন থেকেই মানুষকে উদ্ধার, আশ্রয় কেন্দ্রে নিয়ে যাওয়া, খাবার বিতরণ করে আসছি। প্রত্যেকটা ক্ষতিগ্রস্থ লোকেরা তালিকা করে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে।

ময়মনসিংহ জেলা মৎস কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন বলেন, অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে ৭ হাজার ৮০ জন মৎসচাষি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। অবকাঠামোর ক্ষতি হয়েছে ২১৭ লাখ, ভেসে গেছে ৫ হাজার ৬২৪ লাখ টাকার মাছ ও রেনু পোনা ভেসে গেছে ১৪৯ লাখ টাকার। মৎসখাতে মোট ৫ হাজার ৯৮৮ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।


পরিস্থিতি পরিদর্শন শেষে ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া বলেন, আমাদের সকল ধরণের প্রস্তুতি আছে। বন্যাদুর্গত মানুষের খাদ্যসহ, যে চাহিদা সে মোতাবেক সরকার আমাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ সহায়তা দিয়েছে। প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় আমাদের সচিব স্যার প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সাথে কথা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, উপজেলাগুলোতে ৫৮টি আশ্রয় কেন্দ্র ঘোষণা করেছি। সবাই একসাথে কাজ করছে। তাদের জন্য রান্না করা খাবার, শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। সবাই মনে করছি যদি বৃষ্টিটা কমে যায় তাহলে পানি নেমে যাবে তবে বৃষ্টিটা কমছে না। আবহাওয়া অফিস বলছে আরও একদিন বৃষ্টি থাকতে পারে। আমরা সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা কাজ করছি।

Related News