২০০ বছরের কালের সাক্ষী নরসিংদীর নীলকুঠির চিমনি

, জাতীয়

শরীফ ইকবাল রাসেল, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা ২৪.কম, নরসিংদী | 2024-10-07 19:32:39

নরসিংদীর রায়পুরায় মাহমুদাবাদ গ্রামে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের নীলকুঠি বাস স্ট্যান্ডের উত্তর দিকে একটি কাঁচা মেঠো পথে তিন’শ গজ যেতেই চোখে পড়বে একটি চিমনি। ইংরেজদের শোষণের প্রতীক হিসেবে ২০০ বছরের কালের সাক্ষী হিসেবে মির্জাপুর ইউনিয়নের মাহমুদাবাদ গ্রামে দাঁড়িয়ে আছে চিমনিটি।

পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের পাদদেশে মিস্ত্রি বাড়িতে অবস্থিত নীলকুঠির এই চিমনি। দুই’শ বছর আগে ইংরেজদের কুঠি ছিল এখানে। তারা এখানে নীল আবাদ করত। এখানকার মাটি নীল চাষের জন্য খুব উপযোগী ছিলো।

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বেলাব উপজেলার সররাবাদ, নিলক্ষ্য, রায়পুরা উপজেলার বটতলী, মির্জানগর, হাইরমারা, চরসুবুদ্ধি, আগারনগর, মাহমুদাবাদ ও দৌলতকান্দি রেললাইন পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় তখনকার সময় নীল চাষ হতো। পরে এই কুঠির নাম থেকেই এখানে বাস স্ট্যান্ড ও বাজারের নামকরণ করা হয় ‘নীলকুঠি’ নামে। যা নরসিংদী জেলা সদর থেকে ৩৮ কিলোমিটার দূরে ভৈরব থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার ঢাকা সিলেট মহাসড়কের পাশেই অবস্থিত। নীলচাষের ইতিহাস বহন করে কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে চিমনিটি। চিমনির উচ্চতা প্রায় ৭৫ ফুট প্রস্থ ১০ ফুট। ২ ফুট পুরুত্বের দেওয়াল। চিমনিটি ইটের তৈরি দেওয়ালে এখন সৃষ্টি হয়েছে অনেক গর্ত। অযত্নে পড়ে থাকায় বর্তমানে সাপ, পাখিসহ নানা কীটপতঙ্গের বাসস্থান হিসেবে পরিণত হয়েছে।

নিলকুঠি মিস্ত্রি বাড়ির জয়নাল আবেদিন মিস্ত্রি বার্তা২৪.কমকে জানান, তার পূর্ব পুরুষদের আদি ভূমি ছিল যশোরে। এককালে এখানে কোনো জনবসতি ছিল না। জনমানবহীন জায়গাটিতে তিন ইংরেজ বসতি গড়ে তোলার মনস্থ্য করেন। তাদের নাম জিপি ওয়াইজ, ডাব্লিউ ওয়াটস ও জর্জ লেমন। ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে জাহাজ ভিড়িয়ে কুঠি স্থাপন করেন তারা। নীল উৎপাদনের জন্য তাদের দরকার ছিল দক্ষ শ্রমিক। তখন এখানে সে রকম দক্ষ শ্রমিক ছিল না। তাই ইংরেজরা যশোর জেলা থেকে একজন দক্ষ শ্রমিক নিয়ে আসেন। তার নাম ছিল মনোহর মিস্ত্রি। তার হাত ধরেই এ অঞ্চলের নীল উৎপাদন শুরু। পরে তিনি এখানে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। সেই মনোহর মিস্ত্রি থেকেই আজকের এই মিস্ত্রি বাড়ি হিসেবে পরিচিতি। পাতা থেকে নীল প্রাপ্ত বয়স্ক নীলগাছের পাতার অংশবিশেষ কেটে বড় সড় পাত্রে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর পানি ছেঁকে আরেকটি পাত্রে ঢালা হয়। অনেকক্ষণ পানি নাড়লে নীল রং বেরিয়ে আসে। তারপর চুল্লির আগুনে গরম করলে পানি বাষ্পীভূত হয়ে নীল নিচে জমা হতো। তখন চিমনি দিয়ে উড়ে যেত সাদা ধোঁয়া।

জয়নাল মিস্ত্রি আরও জানালেন, কৃষকরা নীল চাষ করতে চাইতেন না। কিন্তু তারা নীল করদের থেকে দাদন নিয়ে আটকে যেতেন। কোনো কোনো সময় তারা ঘরবাড়ি ছেড়েও পালাতেন। তখন নীল কররা কৃষকদের ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিত। এক সময় এখানকার কৃষকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে নীল বিদ্রোহ শুরু করেন। এজন্য ইংরেজরা তাদের পেছনে লাঠিয়াল বাহিনী লেলিয়ে দেয়। এসময় প্রতিবাদি কৃষককে জ্বলন্ত চুল্লিতে পুড়িয়ে মারার ঘটনাও ঘটেছে।

কুঠির দক্ষিণ দিকে পুরনো দালানে বাস করেন আবুল কালাম মিস্ত্রি। তিনি জানান, অযত্নে অবহেলায় চিমনিটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এটি ইতিহাস ধরে রেখেছে। এর সংরক্ষণে সবার সহযোগিতা দরকার।

Related News