অস্থির চালের বাজার, নিয়ন্ত্রণ করে কে?

, জাতীয়

রাজু আহম্মেদ, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2024-10-20 11:30:18

‘মিস্ত্রির কাজ করি। দিনে যা ইনকাম হয় তা দিয়ে দুইবেলা খাবার জোটে না। সবজির যে দাম তাতে আলুভর্তা দিয়ে এখন ভাত খাওয়া মুশকিল। তার ওপর চালের দাম বাড়ছে। এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? বাসায় মা ও স্ত্রী অপেক্ষা করছে বাজার করে নিয়ে গেলে খাবে, সেটা তো হচ্ছে না।’

আবেগকে খুব কষ্টে নিয়ন্ত্রণ করে এভাবেই জীবনের কঠিন বর্ণনা দিচ্ছিলেন মোটরপার্টস মিস্ত্রি মোহাম্মদ হীরা। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন বৃদ্ধির মধ্যে নতুন করে চালের দাম বৃদ্ধির আঘাতটা নিতে পারেননি তিনি। বক্তব্যে ফুটে ওঠেছে স্পষ্টভাবে। সংসার চালানোর দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরাতে পারবেন না, তাই দিনের রোজগারের অর্ধেক দিয়ে বাসায় বৃদ্ধা মা ও স্ত্রী মুখে ভাত তুলে দিতে মাত্র দুই কেজি চাল কিনে ঘরে ফিরছিলেন তিনি।

নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে মোহাম্মদ হীরার মত খেটে খাওয়া মানুষের এমন করুণ অভিযোগ বেশ পুরনো। গত দুই সপ্তাহে ৩ দফায় বেড়েছে চালের দাম। আটাশ, উনত্রিশ, মিনিকেটসহ বস্তা প্রতি চালের প্রকারভেদে দাম বেড়েছে ১০০ থেকে ২০০ টাকা। এতে মরার উপর খাঁড়ার ঘা অবস্থা মানুষের।

অবস্থাটা আরও স্পষ্ট হলো রাজধানীর বাদামতলী এলাকার ঠেলাগাড়ি চালক কায়সার আলির বক্তব্যে। দৈনিক তার আয় পাঁচশো বা তার কিছু বেশি। সে আয়ে ৬ সদস্যের পরিবারে একবেলা ভালো খেলেও অন্যবেলা আর জোটে না ভালো খাবার। তিনি বলেন, যা আয় হয় তা দিয়া তরকারি কেনা হয় না। এখন চালের দাম বাড়ছে। কেমনে চলবো, বলেন আপনি। ক্যামেরা করে তো কিছু কমে না। দেশের কোন মা-বাপ নাই, যে যার মত বাড়াচ্ছে। নতুন সরকার আসলো, দাম তো কমলো না।

শওকত মিয়া নামের এক রিকশাচালকের বক্তব্য অনেকটাই কায়সার আলির মতো। তবে এমন সংকটে তার আক্ষেপ ছেলের লেখাপড়া চালাতে না পারার। তিনি বলেন, আগে বাজার করে টাকা বাঁচত। এখন শেষ হয়ে যায় বাড়ি ফেরার আগে। টাকার জন্য ছেলেটার লেখাপড়াও করা হলো না। সরকার হয় দাম কমাক, নয়তো আমাদের রোজগার বাড়াক। আমাগো আর জীবন চলে না। যা কিনি তাতে দাম। চালের দামটাও বাড়ছে।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল কমবে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম। খেটে খাওয়া মানুষের বক্তব্যে তা স্পষ্ট। অথচ হয়েছে তার উল্টোটা। নিত্যপণ্যের বাজারের পাশাপাশি হঠাৎ কেন অস্থির হলো চালের বাজার? কে বা কারা নিয়ন্ত্রণ করে এ বাজার?

মাথায় করে চাল স্থানান্তর করছে কুলিরা, ছবি: বার্তা২৪.কম

চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে বাজারে মজুদ নেই এমন উড়োখবর মিলছে হাটবাজারে। তবে বার্তা২৪.কম কুষ্টিয়ায় দেশের সব থেকে বড় চালের মোকামসহ অন্যান্য মোকাম, আড়ত ও মিলে খোঁজ নিয়ে উড়োখবরের কোন সত্যতা পায়নি। এছাড়া রাজধানীর সব থেকে বড় পাইকারি চালের আড়ত বাবুবাজার ও বাদামতলীতেও নেই চালের সংকট। খোদ এখানকার ব্যবসায়ীদের দাবি সাম্প্রতিক বন্যার কারণে চালের দাম কিছুটা বাড়লেও মূলত বন্যাকে পুঁজি করেই চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে মিল মালিকরা।

বাবুবাজার চালের আড়তের ব্যবসায়ী ইসলাম। পঁচিশ বছর ধরে পাইকারি চাল বিক্রির ব্যবসা করছেন। তিনি বলেন, চালের দাম বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। বৃষ্টিবাদলে চালের দাম কিছুটা বাড়লেও মিল মালিকরা অবৈধভাবে মজুদ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছে।

আরেক ব্যবসায়ী আকরাম হোসেন বলেন, চালের দাম বাড়া-কমার খেলা খেলে মিল মালিকরা। আমাদের হাতে কিছু নাই। বাজারে তো মালের সংকট নাই। অথচ বিক্রি নাই। বন্যার কারণে বাজারে সংকট সৃষ্টি করে দামটা বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা বস্তা প্রতি একটু লাভ পাইলে মাল ছেড়ে দেই।

তথ্য বলছে, কুষ্টিয়া, দিনাজপুরসহ হাতেগোনা কয়েকটি জেলা থেকে সারাদেশেই সরবরাহ হয় চাল। আর এসব চালের বাজার নিয়ন্ত্রণ করে মিল মালিকরাই। ধান মজুদ, উৎপাদন ও বাজারজাতকরণের কোন নিয়মনীতি না থাকায় বছরজুড়েই ধানের মজুদ ও সরবরাহ জিম্মি থাকে মিল মালিকদের হাতে। এছাড়া এ খাতে ব্যবহৃত পরিবহন ভাড়াও নির্ধারণ করে মিল মালিকরা। ফলে এর বড় প্রভাব পড়ে চালের দামে।

ঠেলাগাড়িতে করে চালের বস্তা বহন করা হচ্ছে। ছবি: বার্তা২৪.কম

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী বলেন, চালের দাম বাড়ার পেছনে সব থেকে বড় ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির একটি ব্যবসায়ী চক্র। এছাড়া তেলের দাম কমলেও মিল মালিক নিয়ন্ত্রিত পরিবহন সিন্ডিকেট ভাঙে না এ সেক্টরে। বর্তমানে কুষ্টিয়া থেকে এক বস্তা চাল ঢাকায় আনতে শুধু ট্রাক খরচ হয় ১০০ টাকার বেশি। যা সম্পূর্ণ ওঠে ভোক্তার খরচের খাতায়। ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে বস্তা প্রতি ৪০ টাকা খরচই যথেষ্ট, এতে কমাবে ক্রেতার খরচ।

চালের দাম বৃদ্ধিসহ এসব অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশ চালকল মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রশীদের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে সম্প্রতি চালসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির খবরে বাজার পরিদর্শন করেছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহম্মেদ। সরকার দ্রব্যমূল্যের দাম কমানোর চেষ্টা করছে বলে জানান তিনি

Related News