‘ব্যাগ দে নাইলে কোপ দিমু’

, জাতীয়

আল-আমিন রাজু, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-10-24 21:01:21

সম্প্রতি অস্ত্রের মুখে অজ্ঞাত এক তরুণীর ব্যাগ ছিনতাইয়ের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। জানা গেছে, ভিডিওটি মোহাম্মদপুর থানার নবোদয় হাউজিং এলাকার। স্থানীয়দের অভিযোগ, মোহাম্মদপুরের প্রতিটি এলাকায় দিনে-দুপুরে অস্ত্রের মুখে ছিনতাই এখন নিত্যদিনের ঘটনা। ভুক্তভোগী তরুণী অপরিচিতি হলেও এলাকার বাসিন্দা হিসেবে তারা অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়েছেন।

বার্তা২৪.কমের হাতে আসা ৩৩ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যায়, কাঁধে ব্যাগ নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক নারী। পেছন থেকে এক তরুণ দৌড়ে গিয়ে তার পথরোধ করেন। কোমড়ের পেছনে থাকা চাপতি বের করে কথা বলতে দেখা যায়। এর কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ব্যাগ ধরে টানাটানি শুরু হয়। ভুক্তভোগী নারী ব্যাগটি না ছাড়ায় তার হাতে কোপ দেওয়া হয়। যদিও ভাগ্যগুনে রক্ষা পান তিনি। টানা-হেঁচড়ার এক পর্যায়ে নারীর শরীরে থাকা ওড়না ও কাঁধের ব্যাগ ছিনতাইকারীদের হাতে চলে যায়। সব ফেলে দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করেন ওই নারী।

ভিডিওটির সূত্র ধরে ভুক্তভোগীর পরিচয় জানার চেষ্টা করে বার্তা২৪.কম। ঘটনাস্থলে সম্পর্কে জানা গেছে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর থানার নবোদয় হাউজিং এলাকার ডি ব্লকের ৪/এ সড়কের রোজ গার্ডেন নামের একটি ভবনের সামনের দিকের ঘটনা। গত ২১ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে অস্ত্রের মুখে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে। ঘটনাস্থলের ৫০ গজ দূরের একটি বহুতল ভবনেই থাকতেন ভুক্তভোগী মাইশা আক্তার (ছদ্মনাম)।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মাইশা। তার গ্রামের বাড়ি কেরানীগঞ্জের দোহার থানায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের যাতায়াতের সুবিধার জন্য রাজধানীর মোহাম্মদপুরের নবোদয় হাউজিং এলাকায় খালার বাসায় থাকতেন। গত ২১ তারিখ সকাল সাড়ে ৬টা দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হয়েই একদল অস্ত্রধারী ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। অস্ত্রের মুখে ছিনতাইকারীরা গতিরোধ করে ব্যাগ নেওয়ার জন্য টানা-হেঁচড়া করেন। ব্যাগ দিতে না চাইলে ছিনতাইকারীরা বলে, ‘ব্যাগ দে নাইলে কোপ দিমু’।

অভিযুক্তরা

এক পর্যায়ে জীবন বাঁচাতে ব্যাগ দিয়ে দেন ওই ছাত্রী। ছিনতাইকারী দলের এক সদস্য ওড়না ফেলে দিয়ে ব্যাগ নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যান।

ভুক্তভোগী তরুণীর বড় বোন জান্নাতুল সুরভী বার্তা২৪.কম-কে বলেন, আমার বোন এই ঘটনার পরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে। সে প্রচন্ড ভয় পাচ্ছে। এছাড়া ছিনতাইকারীরা যেভাবে হামলা করেছে তাতে তার বড় ধরনের ক্ষতি হতে পারতো। অল্পের জন্য বেঁচে গেছে।

তিনি আরও বলেন, আমার ছোট বোন ছিনতাইয়ের ঘটনার পাশাপাশি আরেকটা বিষয় নিয়ে খুব বিব্রত সেটা হলো তার বুকের ওড়নাটাও টান দিয়ে নিয়ে নেওয়া হয়।

‘আমার বোনের ব্যাগে মোবাইল ও কিছু টাকা ছিলো। এগুলোর বাইরে তার ব্যাগে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইডি কার্ডসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ছিলো। যেগুলো তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা ইতোমধ্যে থানায় একটা অভিযোগ দিয়েছি।’- বলেন সুরভী।

মাইশার ঘটনাটি মর্মান্তিক হলেও থানা নিয়েছে মোবাইল ও আইডি কার্ড হারানোর জিডি।  হারানো জিডির বিষয়ে সুরভী বলেন, আমরা কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ দেইনি। মোবাইল, আইডি কার্ড ও গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র হারানোর ঘটনায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছি।

এদিকে, স্থানীয় একটি সূত্রের মাধ্যমে মাইশার ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িতদের শনাক্ত করেছে বার্তা২৪.কম। জানা গেছে, ছিনতাইকারীদের বেশিরভাগ বয়সে কিশোর হলেও পেশাদার ছিনতাইকারী। মোহাম্মদপুর জুড়ে দাপিয়ে বেড়ানো একটি দুর্ধর্ষ চক্রের সদস্য তারা। মোহাম্মদপুরের ‘হাত কাটা গ্যাং’ হিসেবে পরিচিত। এই চক্রটি দীর্ঘদিন কিলার বাদলের ছত্র ছায়ায় থাকলেও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তারা স্থানীয় এক বিএনপি নেতার আশ্রয়ে বীরদর্পে অপরাধ ঘটিয়ে চলছে। মোহাম্মদপুরের সম্প্রতি ঘটে যাওয়া বিল্লাল ওরফে ফাইটার বিল্লাল হত্যা, নেসলে কোম্পানির গাড়ি থেকে ১১ লাখ টাকা ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধ ঘটিয়ে চলেছে চক্রটির সদস্যরা।

সিসিটিভির চিত্রে দেখা যায়, ছিনতাইয়ের শিকার শিক্ষার্থীকে অস্ত্র হাতে পথরোধ করা কিশোরের নাম রতন, পরবর্তীতে যোগদেন শেখেরটেকের ফয়সাল ওরফে একা, নবোদয় হাউজিং বাজারের পাশের বস্তির শাওন, লিটকি ও একই এলাকার হামিদ বাবুর্চির ছেলে ইব্রাহিম ওরফে ইবু। গত সেপ্টেম্বর মাসে অটোরিকশার যাত্রীকে কুপিয়ে আহতের ঘটনায় এই চক্রটি জড়িত।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি সূত্র জানিয়েছে, অপরাধ কার্যক্রম চালানোর জন্য এই চক্রটির বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। সম্প্রাতিক সময়ে ঘটে যাওয়া ছিনতাইয়ের ঘটনায় জড়িতরা চক্রটির কিশোর গ্রুপের সদস্য। এই চক্রের উপরের দিকের সদস্যরা ডাকাতি ও চাদাঁবাজিসহ বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। তবে অজানা কারণে তাদের আইনের আওতায় আনা যাচ্ছে না।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভিডিওটি আমি দেখেছি। ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। কিন্তু তারা কোনো অভিযোগ বা মামলা দিতে চান না। তারপরও আমরা জড়িতদের শনাক্তে কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, ভিডিওতে দেখলাম ছিনতাইয়ে জড়িত কারো বয়সই ১৫ বছরের বেশি না। অথচ তারা কিভাবে ধারালো অস্ত্র দিয়ে মানুষকে আঘাত করছে। আমরা কাজ করছি। জড়িতরা কেউই ছাড় পাবে না। 

মোহাম্মদপুরে নারী শিক্ষার্থীসহ সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনার বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুলিশ ও অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. ওমর ফারুক বার্তা২৪.কমকে বলেন, বহু বছর ধরেই মোহাম্মদপুর ক্রিটিক্যাল ক্রাইম জোন। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই এলাকাটি অপরাধপ্রবণ এলাকা। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে এ এলাকায় অপরাধ তুলনামূলক আরও বেড়েছে। কারণ বর্তমানে পুলিশ বাহিনীর বর্তমান যে অবস্থা, তাতে এ মুহূর্তে তাদের পক্ষে বড় কোনো অ্যাকশনে যাওয়া সম্ভব নয়। তাই দ্রুত পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করে তাদের পূর্ণ শক্তিতে মাঠে কাজ করতে দিতে হবে। পুলিশের সুযোগটিই অপরাধীরা লুফে নিচ্ছে।

‘আমাদের যৌথ বাহিনী কাজ করার কথা শুনেছি। তারা যদি কোন এলাকায় অপরাধ বেশি সেটি বিশ্লেষণ করে কাজ করতে হবে। তাদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা অপরাধীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করবেন।’- বলেন এই বিশেষজ্ঞ।

Related News