গাইবান্ধায় ল্যাব সহকারীর বিলাসবহুল ভবন, আছে গ্রামেও

, জাতীয়

মাসুম বিল্লাহ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেস্ট, বার্তা২৪.কম গাইবান্ধা | 2024-10-25 00:18:01

পলিটেকনিকের এক ল্যাব সহকারী গাইবান্ধা জেলা শহরে নির্মাণ করেছেন অননুমোদিত বিলাসবহুল ৫ তলা ভবন। ভবনটি নির্মাণে গাইবান্ধা পৌরসভার তিনতলা পর্যন্ত অনুমতি থাকলেও নির্মাণ করা হয়েছে ৫ তলা। গাইবান্ধা পৌরসভা ভবনটির নকশা বহির্ভূত অংশ অপসারণে নোটিশ দিলেও কোনো তোয়াক্কাই করেনি ভবনের মালিক ওই ল্যাব সহকারী।  

গাইবান্ধার পৌর শহরের থানা পাড়ায় আধুনিক ওই ভবনের মালিকের নাম মিজানুর রহমান সবুজ। তিনি রংপুর পলিটেকনিক্যালের একজন ল্যাব সহকারী। সম্প্রতি গাইবান্ধা টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজে সংযুক্তিতে বদলি নিয়ে এসেছেন তিনি।

সূত্র জানায়, শুধু শহরে নয়, গ্রামেও রয়েছে তার একতলা ভবন। তৃতীয় শ্রেণির একজন কর্মচারী চাকরি জীবনের মাত্র তিন বছরে গাইবান্ধা জেলা শহরে ৫ শতাংশ জায়গা ক্রয় এবং তার ওপর ৫ তলা ভবন নির্মাণ করে তিনি এখন গাইবান্ধার টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছেন। একই সাথে সাধারণ মানুষের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুও এখন সবুজ। চার বছর আগেও দাঁতের চিকিৎসা দেওয়া এই সবুজ রাতারাতি বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক হওয়ায় রীতিমতো আশ্চর্য তার গ্রামের স্বজন ও প্রতিবেশীরাও।

গাইবান্ধা পৌরসভায় ভবনটির 'নিয়ন্ত্রণসহ অবকাঠামো লে-আউট প্লানের অনুমোদন পত্র' এবং সংশ্লিষ্ট প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানায়, পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডের গোবিন্দপুর মৌজার (জেএল নং ৯৯) ৫ শতাংশ জমির উপর ভবন নির্মাণের আবেদন করেন মিজানুর রহমান সবুজ। আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০২৩ সালের ১২ জুন ভবন নির্মাণ আইন ১৯৫২-৫৩ এর ধারা (৩) অনুযায়ী তিন (৩) তলা আবাসিক (পাকা) ভবনের অনুমোদন দেয় গাইবান্ধা পৌরসভা। কিন্তু সেখানে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ওই ৩ তলার উপরে আরও ২ তলাসহ একইভাবে মোট ৫ তলা ভবন নির্মাণ করা হয়। যা পৌরসভার ভবন আইন লঙ্ঘন এবং অপরাধ।


পরে অনুমোদনকৃত নকশার বহির্ভূত ভবনের কাজ করায় একই বছরের ৭ নভেম্বর ওই ভবনের 'নকশা বহির্ভূত অংশ অপসারণে' একটি পত্র দেয় গাইবান্ধা পৌরসভা। তৎকালীন মেয়র মতলুবর রহমান স্বাক্ষরিত ওই পত্রে বলা হয়, আপনি ভবন নির্মাণের নকশার অনুমোদন নিয়ে ওই নকশা বহির্ভূত কাজ করেছেন। যা ইমারত নির্মাণ বিধি ১৯৯৬ এর পরিপন্থী। এছাড়াও পত্রে পত্র প্রাপ্তির ৭ দিনের মধ্যে সকল প্রকার অনুমোদন বহির্ভূত অংশগুলো অপসারণ করে পৌরসভাকে অবহিত করতেও বলা হয়। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-১৯৯৬ এবং স্থানীয় সরকার আইন (পৌরসভা)-২০০৯ এর বিধি আইন মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু, পৌরসভার ওই পত্রের কোনো তোয়াক্কাই করেনি ভবনের মালিক মিজানুর রহমান সবুজ। অপরদিকে, পৌরসভার পক্ষ থেকে নোটিশের পর ১১ মাস পার হলেও আর কোনো ধরনের পদক্ষেপ নেয়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।

অনুমোদনহীন এই ভবন মালিককে নোটিশ করা হলেও পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এখনো পর্যন্ত কেন ব্যবস্থা নেয়নি- এমন প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর মেলেনি গাইবান্ধা পৌরসভার কাছ থেকে।

বিধিবহির্ভূত ভবন নির্মাণের বিরুদ্ধে আইন যা বলছে:

স্থানীয় সরকার (পৌরসভা) আইন ২০০৯ এর দ্বিতীয় তফসিলের ধারা ৩৬ এর ২-এ বলা হয়েছে, শর্তের অতিক্রম বা লঙ্ঘন করে যদি কোন ইমারত নির্মাণ করা হয় তবে পৌরসভা ইমারতটি পরিবর্তনের নির্দেশ দিতে পারবে। এছাড়া ইমারতের মালিকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে শর্ত সাপেক্ষে অপরাধের আপোষ মীমাংসা করতে পারবে। তবে, অনুমোদিত ভূমি উন্নয়ন স্কিমের শর্তের অতিক্রমণ অথবা লঙ্ঘনজনিত অপরাধে আপোষ মীমাংসা করা যাবে না।

সেক্ষেত্রে একই ধারার (৩) দফা (২) এ বলা হয়েছে, শর্তের অধীনে পৌরসভা নিজস্ব অনুসংগঠনের (এজেন্সি) মাধ্যমে ইমারত ভেঙে ফেলতে পারবে এবং ওই ভবন ভাঙতে পৌরসভা কর্তৃক যে অর্থ ব্যয় হবে। তা এই আইনের অধীনে ইমারত মালিক বা দখলকারের উপর আরোপিত কর হিসেবে গণ্য হইবে।

সরেজমিনে দেখা যায়, গাইবান্ধার শহরের থানা পাড়ায় গাইবান্ধা সরকারি কলেজের দক্ষিণ পার্শ্বে গাইবান্ধা-নাকাইহাট সড়ক থেকে ২০০ মিটার ভিতরে সবুজের আধুনিক দুই ইউনিটের ৫ তলা কালারফুল ভবন। বাড়িটির ওপেন পার্ট সম্পূর্ণটাই টাইলস করা। জানালায় থাই, ওয়াইফাই, সিসি ক্যামেরায় আবৃত ওই এলাকার এটিই সব থেকে আধুনিক ডিজাইনের আকর্ষণীয় বাড়ি। বাড়িটি পাঁচ শতাংশ জায়গার ওপর দণ্ডায়মান। জমিসহ যার বর্তমান বাজার মূল্য কমপক্ষে ৪ কোটি টাকারও বেশি। ওই বাড়ি সংলগ্ন আরও পাঁচ শতক জমি ক্রয় করেছেন বলেও একটি সূত্র জানায়।

শুধু শহরেই নয়, সবুজের গ্রামের বাড়ি রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ডিব বাজার এলাকায় সরেজমিনে দেখা যায়, পুকুরের উপর একতলা নতুন ভবন। আছে এসিও। যদিও সেটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। সবুজ পরিবারসহ শহরের বাড়িতেই থাকেন। সবুজের বাবার নাম মৃত আমিনুল ইসলাম। তিনি ছিলেন সোনালী ব্যাংকের ক্যাশিয়ার।

কিভাবে সম্ভব হলো এত সম্পদ?

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে অভিযুক্ত সবুজের এক স্বজন মোবাইল ফোনে জানান, ১৯৯৫ সালে সবুজের বয়স যখন দুই বছর ওই সময়ে তার বাবা আমিনুল মারা যান। বিমাতা সংসারে ছয় ভাই-বোনের এক মায়ের সবুজসহ তিনভাই এক বোন। সবুজের দুই বড় ভাই টিভির মেকার। কল মেকার হিসেবেই তাদেরকে স্থানীয়রা ভালো চেনেন। অর্থাৎ বাড়ি বাড়ি গিয়ে তারা টিভি মেরামত করেন। ওয়ারিশ সূত্রে সবুজরা প্রত্যেকেই আড়াই বিঘার মতো করে জমি পেয়েছেন। যার বাড়ি-ভিটা ছাড়া সবই বিক্রি করেছে সবুজ। তবে, যা বিক্রি করেছে-পরে ফুফুর জমিসহ ক্রয়ও করেছে সমপরিমাণ জমি।

স্থানীয়রা জানান, গেল ৪ বছর আগেও সবুজ স্থানীয় বালুয়া নামক বাজারে একটি ডেন্টাল কেয়ার দিয়ে সেখানে দাঁতের চিকিৎসা করতেন। তবে, হঠাৎ কয়েক কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়ায় মাটিতে যেন পা পড়ে না সবুজের। চলাফেরায় রীতিমতো হতভম্ব তার স্বজন ও স্থানীয় মানুষ। তাদের জিজ্ঞাসা কী করে এত দ্রুত কোটি কোটি টাকার মালিক বনে গেলেন মিজানুর রহমান সবুজ কেউ তা জানেন না।

ডিভাইস সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ:

একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর সূত্রে জানা গেছে, সবুজ স্থানীয় একটি ডিভাইস সিন্ডিকেটের সাথে জড়িত। সরকারি চাকরিতে পরীক্ষার্থীদের ইলেকট্রনিক্স ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে সহায়তা করেন এবং এর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন। এই সিন্ডিকেটে তার স্ত্রী আঞ্জুয়ারা খাতুনেরও নাম এসেছে। তিনি একজন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। তিনিও সহযোদ্ধা হিসেবে কাজ করছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে। আঞ্জুয়ারাও গত দুই মাস পূর্বে বাদিয়াখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পৌর এলাকার পশ্চিম গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ডেপুটেশনে এসেছেন। মূলত এই ডিভাইস সিন্ডিকেটের কারণে তারা দুজনেই শহরে সংযুক্তি নিয়ে এসেছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। এই সিন্ডিকেটকে সদর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সংশ্লিষ্টরাও সহযোগিতা করেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

মিজানুর রহমানের বড় ভাইয়ের স্ত্রী শিউলি বেগম গোপন ক্যামেরায় বলেন, সবুজ বউ নিয়ে শহরের বাড়িতে থাকে, গ্রামে কম আসেন। চাকরি নিয়ে দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবুজ আগে মানুষকে চাকরি নিয়ে দিতেন কিন্তু এখন আর ওগলা (ওইসব) করেন না, বাদ দিছেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাঙ্গা ডিব বাজারের এক ব্যবসায়ী জানান এলাকাসহ আশে-পাশের এলাকার বহুজনকে চাকরি দিয়েছে সবুজ। একেকটি চাকরি দিতে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা পর্যন্ত নেন তিনি।

সবুজের প্রতিক্রিয়া:

হঠাৎ বিপুল পরিমাণ সম্পদের মালিক হওয়া এবং আয়ের উৎস সম্পর্কে জানতে চেয়ে মিজানুর রহমানের শহরের বাড়িতে গেলে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি তিনি। পরে মোবাইল ফোনে তিনি ডিভাইস সিন্ডিকেটের বিষয়টি বার্তা২৪.কমের কাছে অস্বীকার করেন।

তবে এসময় তিনি বলেন, তার দুই বউ একজন প্রাইমারিতে এবং আরেকজন স্বাস্থ্য সহকারী হিসেবে সরকারি চাকরি করেন। তিনি নিজেও একজন সরকারি চাকরিজীবী। তিনি দাবি করেন বলেন, আমার নিজের নামে ৬০ লাখ টাকা, এক স্ত্রীর নামে ১০ লাখ এবং আরেক স্ত্রীর নামে ১৩ লাখ টাকাসহ প্রায় ১ কোটি টাকার মতো ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছি। এছাড়া গ্রামে জমি বিক্রি করেছি, আমার ব্যবসাও আছে। আমার কোন অবৈধ উপার্জন নেই। যদি মানুষ অভিযোগ করে থাকে তাহলে সেসব মিথ্যা।

কর্তৃপক্ষের প্রতিক্রিয়া: 

এসব ব্যাপারে গাইবান্ধা টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজের অধ্যক্ষ ইঞ্জিনিয়ার নূর মো. আনোয়ার রশিদ বলেন, মিজানুর রহমান সবুজ ১৬তম গ্রেডের একজন কর্মচারী। তার বেসিক বেতন মাত্র ৯৩০০ টাকা। সম্প্রতি সবুজ এখানে সংযুক্তিতে এসেছে। তার বিপুল সম্পত্তি এবং কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আমাদের জানা নেই।

গাইবান্ধা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা (ডিপিও) মোবাইল ফোনে মো. নবেজ উদ্দিন সরকার বলেন, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সুপারিশের ভিত্তিতে সহকারী শিক্ষক আঞ্জুয়ারাকে শহরের স্কুলে সংযুক্তি দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

গাইবান্ধার পৌরসভার প্রশাসক ও স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক শরিফুল ইসলাম বার্তা২৪.কমকে বলেন, পৌরসভা আইনের তোয়াক্কা না করে ওই ভবন মালিক অবৈধভাবে পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করেছেন, যা বেআইনি এবং গুরুতর অপরাধ। বাড়িটির অনুমোদন বহির্ভূত অংশ অপসারণে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল, কাজ হয়নি। বেআইনি ভবন নির্মাণের বিষয়ে বিধি মোতাবেক দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। 

Related News