আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচনার সম্ভাবনা

, জাতীয়

ড. মাহফুজ পারভেজ, অ্যাসোসিয়েট এডিটর, বার্তা২৪.কম | 2024-11-23 21:32:18

জাতিসংঘ কর্তৃক রোহিঙ্গাদের "বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত সংখ্যালঘু" হিসেবে বর্ণনা করা হলেও সেখানে রোহিঙ্গা ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে খুব কমই। বাংলাদেশের ৯৫ শতাংশ রোহিঙ্গা পরিবার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবিক সহায়তার উপর নির্ভরশীল হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক ফোরামে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে গৃহীত উদ্যোগ নেই বললেই চলে। অবশেষে আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচিত হওয়ার একটি সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

খবরে প্রকাশ, রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য ২০২৫ সালে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে নিয়ে উচ্চপর্যায়ের জাতিসংঘ সম্মেলন আয়োজনের একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে। ২২ নভেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। গত সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বানের অংশ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ওআইসি ও ইইউর যৌথভাবে পেশ করা ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্য সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার পরিস্থিতি’ শীর্ষক প্রস্তাবটি ইউএনজিএর তৃতীয় কমিটিতে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে, এটিকে ১০৬টি দেশ সমর্থন দিয়েছে, যা আন্তর্জাতিক সমর্থনের একটি উল্লেখযোগ্য স্তরে পৌঁছেছে।

প্রস্তাবটির মাধ্যমে সদস্য রাষ্ট্রগুলো ২০২৫ সালে যতটা দ্রুত সম্ভব মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর পরিস্থিতি নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে একটি উচ্চ স্তরের সম্মেলন করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিমদের স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনসহ সংকটের টেকসই সমাধানের জন্য একটি ব্যাপক, উদ্ভাবনী, সুনির্দিষ্ট ও সময়াবদ্ধ পরিকল্পনা প্রস্তাব করার জন্য সম্মেলনের লক্ষ্য সামগ্রিক সংকট পর্যালোচনা করা। এ বছর অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে প্রস্তাবটিতে অন্যান্য দেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা মুসলিমসহ সব শরণার্থীর প্রত্যাবর্তনের অধিকার নিশ্চিত করা এবং স্বেচ্ছা, নিরাপদ, মর্যাদাপূর্ণ ও টেকসই প্রত্যাবর্তন ও পুনর্মিলনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিস্থিতি তৈরি করতে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এতে হত্যা, ধ্বংস ও বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা, শিশুসহ বেসামরিক নাগরিক—বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলিম ও অন্যান্য সংখ্যালঘুর জোরপূর্বক সশস্ত্র বাহিনী অথবা সশস্ত্র গ্রুপে নিয়োগসহ গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অপব্যবহারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়।

প্রস্তাবে অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সমস্ত দায়বদ্ধতা প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। প্রস্তাবটি একটি আঞ্চলিক সংস্থা হিসেবে আসিয়ানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার ওপর জোর দেয়।

সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ায় বাংলাদেশ এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার স্বার্থে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ, স্বেচ্ছায় ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। তাছাড়া, ঐক্যমত্যের মাধ্যমে প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়াও একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ, যা সংকটের টেকসই সমাধানের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির প্রমাণ।

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘস্থায়ী উপস্থিতি কীভাবে একটি জটিলতা সৃষ্টি করেছে, তা সন্মেলনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আরও স্পষ্টভাবে জানতে পারবে। নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারণ পরিষদের তৃতীয় কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবের ফলে রোহিঙ্গা মুসলিমদের প্রত্যাবাসনে উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরির জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়বদ্ধতা বাড়বে, যা বাংলাদেশেট চাপ কমাবে ও মিয়ানমারের উপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়াবে।

সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণের ক্ষেত্রে সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এগিয়ে আসার জন্য একাধিক আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশেনের ফাঁকে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের এক আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমাদের সতর্ক হতে হবে, এই সঙ্কটের সমাধান না হলে শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র অঞ্চল সমস্যায় পড়বে। ফলে, আমাদের অব্যশই এ বিষয়ে মনোযোগ দিতে হবে।’

প্রধান উপদেষ্টা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা সঙ্কট সমাধানে নতুন করে ভাবার প্রস্তাব দেন। তিনি বলেন, ‘প্রথমত আমরা চাই জাতিসংঘ মহাসচিব যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে সকল পক্ষের উপস্থিতিতে একটি সম্মেলনের আয়োজন করুক।’ সম্মেলনে সঙ্কটের সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা পূর্বক নতুন এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন সমাধানের উপায় কী হতে পারে, তেমন প্রস্তাব আসতে হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, দ্বিতীয়ত জাতিসংঘ ও বাংলাদেশ যৌথভাবে পরিচালিত ‘জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান’ কার্যক্রমে নতুন করে প্রাণশক্তি যোগ করার প্রয়োজন। যেহেতু এখন রোহিঙ্গাদের পেছনে ব্যয় করার মতো তহবিলের অভাব রয়েছে, তাই রাজনৈতিকভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে অর্থ সংগ্রহের প্রক্রিয়া আরও জোরদার করতে হবে।

তৃতীয়ত ড. ইউনূস বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণহত্যা অপরাধের বিচার নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই আন্তরিক সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার দ্বারা নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের ন্যায় বিচার নিশ্চিত করা অতীব জরুরি, যা সম্ভব হতে পারে আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। তাছাড়া, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর জন্য বৈষম্য, রাষ্ট্রহীনতা এবং জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত বন্ধ করতে বাংলাদেশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে অবশ্যই প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের উদ্যোগ হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রের তরফে বাংলাদেশ ও তাদের আশ্রয়দানকারী জনগোষ্ঠীর জন্য প্রায় ১৯ কোটি ৯০ লাখ মার্কিন ডলারের নতুন সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। এই মার্কিন সহায়তা জীবন রক্ষা, বিশেষ করে সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা, আশ্রয় এবং খাদ্য সরবরাহে সহায়তা করবে।

সম্প্রতি নতুন করে আসা ৪০ হাজার রোহিঙ্গাসহ বাংলাদেশ বর্তমানে ১৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে। অতীতের সরকার এ সমস্যাকে সমাধানের বদলে জিইয়ে রেখেছিল বলে মনে করেন রোহিঙ্গা কমিউনিটির নেতারা। তবে, রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান এবং মিয়ানমারে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ‘নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ’ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে 'একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন' আয়োজনসহ রোহিঙ্গা সংকটের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ‘জরুরি মনোযোগ’ দেওয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আহ্বান রোহিঙ্গা কমিউনিটিতে ইতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে। এতে, স্থবির ও হতাশ রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে আশার সঞ্চার হয়েছে বলে আমাকে জানিয়েছেন রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক মোহাম্মদ শফিউল্লাহ।

তিনি জানান, 'রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নেতৃবৃন্দ বিশ্বাস করেন সমস্যা সমাধানে বিশ্বনেতৃত্বের ভূমিকা রয়েছে। আন্তর্জাতিক সাহায্য ছাড়া মিয়ানমার ফিরে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ও নিরাপদ নয়। রাখাইন রাজ্য (মিয়ানমার) যারা অব্যাহতভাবে নিপীড়ন, উৎখাত ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছেন, বিশ্ববাসী তাদের উপেক্ষা করতে পারে না। তাই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে জোরালো আন্তর্জাতিক উদ্যোগ আবশ্যক।

রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক সারোয়ার কামাল মনে করেন, 'বিশ্বে নতুন নতুন সংকট সৃষ্টি হওয়ায় আন্তর্জাতিক ফোকাস রোহিঙ্গাদের দিক থেকে ক্রমশ সরে যাচ্ছে বিধায় বিষয়টি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নজরে আনতে অব্যাহত প্রচেষ্টা নিতে হবে। কারণ, অভাব, বঞ্চনা ও হতাশার কারণে রোহিঙ্গারা অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের অনেকেই মাদক, অস্ত্র ও মানব পাচারে অংশ নিতে বাধ্য হচ্ছে। সন্ত্রাসের সঙ্গেও অনেকের সংযোগ তৈরি হচ্ছে। এই পরিস্থিতির আশু অবসান হওয়ার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।

রোহিঙ্গাদের একাধিক সংগঠন স্বদেশ প্রত্যাবাসনের জন্য আগ্রহী হলেও তারা কিছু শর্ত দিয়েছে। যার মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারের নাগরিকত্ব প্রদান এবং স্ব স্ব ঘরবাড়িতে নিরাপত্তার সঙ্গে প্রত্যাবাসন অন্যতম। তাদের মতে, 'প্রাণ নিয়ে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছি, জীবনের নিরাপত্তা না পেলে সেখানে কেন যাবো? আমরা আন্তর্জাতিক সহায়তায় নিরাপত্তার নিশ্চয়তা না পেলে জেনেশুনে মৃত্যুর মুখে ফিরে যেতে পারি না।'

বছরের পর বছর মিয়ানমার সরকারের গণহত্যা ও নির্যাতনে গৃহহীন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরের বিপন্ন পরিস্থিতিতে সন্ত্রাস, বঞ্চনা ও হতাশা কবলিত হলেও তারা স্বদেশ প্রত্যাবাসনের আশা রাখেন। এজন্য তারা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তদারকিতে নিরাপত্তা ও অধিকারের নিশ্চয়তা চান। আন্তর্জাতিক পরিসরে রোহিঙ্গা ইস্যু আলোচনার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ায় শরণার্থী শিবিরের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ক্ষেত্রে আশার আলো দেখতে পাচ্ছে।

Related News