‘ষাটের দশকের দিকে আমাগের এলাকায় স্কুল ছিল না। স্কুল না থাহার কারণে লেহাপড়া তেমন একটা করতে পারি নাই। এলাকার কথা চিন্তা করে তৎকালীন ইসলামপুর ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল গফুর মোল্লা ১৯৬৮ সালে এ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠার পর স্কুলটিতে তেমন লেহাপড়া হতো না। স্কুলে আসলে মহিলারা (ম্যাডাম) ছাত্রীগের দিয়ে মাথার উহুন (উঁকুন) খোঁটাত। তাই এলাকাবাসী এই স্কুলটিকে উহুন খোঁটার স্কুল বলে ডাকত।’
যে প্রাথমিক বিদ্যালয়টি এখন দেশসেরা হওয়ার অপেক্ষায়, সেটি সম্পর্কেই বলছিলেন রাজবাড়ীর বালিয়াকান্দির ইসলামপুর ইউনিয়নের সত্তরোর্ধ্ব ছাদেক আলী মণ্ডল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির নাম স্বাবলম্বী ইসলামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এরই মধ্যে স্কুলটি ২০২৪ সালের জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে ঢাকা বিভাগের শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে।
জানা যায়, বাড়াদী গ্রামে চন্দনা নদীর পূর্বপারে ১৯৬৮ সালে ৩৩ শতক জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ১৫২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে যাত্রা শুরু করে বিদ্যালয়টি। ১৯৮৬ সালে জাতীয়করণ হয়। একসময় এটিকে এলাকাবাসী উঁকুন খোঁটার স্কুল বলে ডাকত। কিন্তু বিদ্যালয়টি এখন সারাদেশের মডেল। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে যে ‘সততা স্টোর’ রয়েছে, সেটি এই বিদ্যালয় থেকেই সৃষ্ট। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম এর প্রতিষ্ঠাতা। সততা স্টোর প্রতিষ্ঠা করে তিনি ২০১৯ সালে দেশসেরা প্রধান শিক্ষক হিসেবে ভূষিত হন। এরই মধ্যে তাঁর উদ্ভাবিত ‘বন্ধু টিম’ ইউনেস্কো ও নায়েমে গৃহীত হয়েছে। এই প্রধান শিক্ষক এবার স্বপ্ন দেখছেন প্রতিষ্ঠানটি দেশের সেরা বিদ্যালয় হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
দৃষ্টিনন্দন শিশুবান্ধব এ বিদ্যালয়ে ৪৬২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। শিক্ষক ১০ জন। প্রাথমিক বৃত্তি ও সমাপনীতে এ প্রতিষ্ঠানের পাসের হার শতভাগ। শিখনঘাটতি পূরণে সরকারি ছুটির দিনগুলোতে সান্ধ্যকালীন অবৈতনিক বিশেষ পাঠদানের ব্যবস্থা রয়েছে।
গত বৃহস্পতিবার বিদ্যালয়টিতে গিয়ে দেখা যায়, এর অঙ্গন ও প্রতিটি শ্রেণিকক্ষ পরিচ্ছন্ন ও সুসজ্জিত। দেয়ালে লেখা মনীষীদের বাণী ও অঙ্কিত শিক্ষণীয় উপকরণ। বিদ্যালয়টিতে রয়েছে শিশুবান্ধব মীনা ও রাজু পার্ক, ফুলের বাগান, মুক্তির স্মৃতিগাঁথা স্কয়ার, অভিভাবক ছাউনি (বকুলতলা), রিডিং কর্নার, নিজ দেশ, জেলা ও উপজেলার মানচিত্র, শহীদ মিনার, নামাজ ঘর, পশুপাখির ম্যুরাল, সাকসেস ও ইয়েস আই ক্যান কর্নার, ডিজিটাল শ্রেণিকক্ষ, বেল, ডিসপ্লে বোর্ড ও ঘড়ি, সততা স্টোর, পতাকা মঞ্চ, শাপলা স্কয়ার এবং ছাদ বাগান।
পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী রিফাত, অর্পা ও রাশিদ জানায়, তারা এ বিদ্যালয় নিয়ে গর্ব করে। শিক্ষকরা খুবই আন্তরিক। তাদের নিয়মিত লেখাপড়া ও নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে থাকতে হয়। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণটি তাদের খুব প্রিয়। পড়ালেখার ফাঁকে তারা খুব আনন্দ করে।
দক্ষিণবাড়ী গ্রামের মীরা খাতুন ও দোপপাড়া পদমদী গ্রামের লাবণী বেগম জানান, সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে তাদের প্রথম পছন্দ এই বিদ্যালয়। প্রায় চার কিলোমিটার দূর থেকে তারা এই বিদ্যালয়ে তাদের সন্তানদের নিয়ে আসেন। এখানে নৈতিক, মানবিক ও ধর্মীয় শিক্ষাও দেওয়া হয়।
প্রধান শিক্ষক শহিদুল ইসলাম জানান, নানা সংকট উপেক্ষা করে বিদ্যালয়টি আজ যে অবস্থানে রয়েছে এর জন্য প্রিয় শিক্ষার্থী, সহকর্মী, অভিভাবক ও এলাকাবাসীর বিশেষ অবদান রয়েছে। সবার সহযোগিতা তিনি পেয়েছেন বলেই বিদ্যালয়টির সুনাম সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। বিদ্যালয়টির মানোন্নয়নে তিনি কখনও কারও সঙ্গে আপস করতে রাজি নন।
শিক্ষা কর্মকর্তা আশরাফুল হক বলেন, শিশুবান্ধব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বলতে যা বোঝেন, এটি তা-ই। এটি একটি আদর্শ বিদ্যালয়। এখানকার শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই নিয়মের মধ্যে থেকেই শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এটি ব্যতিক্রমী বিদ্যালয়।