সংবিধান সংস্কার কমিশনের সুপারিশে যা যা আছে

, জাতীয়

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা | 2025-01-16 11:51:56

সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চূড়ান্ত প্রস্তাব প্রতিবেদন আকারে জমা দিয়েছে। কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রতিবেদনের একটি সার-সংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়েছে।

এতে সাতটি প্রধান বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে সংবিধান সংস্কার কমিশন।

বিষয়গুলো হলো-

১. ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান আদর্শ এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনস্বরূপ সংবিধান ও রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্র’ প্রস্তাব।

২. ক্ষমতার প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, প্রধানমন্ত্রী পদের একচ্ছত্র ক্ষমতা হ্রাস।

৩. অন্তর্বর্তী সরকার কাঠামোর সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব।

৪. বিচার বিভাগের বিকেন্দ্রীকরণ।

৫. শক্তিশালী স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা সুনিশ্চিতকরণ ।

৬. মৌলিক অধিকারের আওতা সম্প্রসারণ।

৭. সাংবিধানিক সুরক্ষা ও বলবৎযোগ্যতা নিশ্চিতকরণ।

এছাড়া সংবিধানের বিদ্যমান প্রস্তাবনার ভাষ্যকে পরিবর্তন করে পুনঃপ্রতিস্থাপন করার জন্য সুপারিশও করেছে কমিশন। প্রস্তাবনার সেই ভাষ্যে উঠে এসেছে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ।

১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ এর ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে মানুষের প্রতিবাদী আন্দোলনের আদর্শকে সামনে রেখে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, আমরা জনগণের সার্বভৌম অধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রকে সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করে জনগণের জন্য একটি সংবিধান রচনা ও বিধিবদ্ধ করছি, যে সংবিধান বাংলাদেশের জনগণের সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ এবং যে সংবিধান স্বাধীন সত্তায় যৌথ জাতীয় বিকাশ সুনিশ্চিত করবে এবং বর্তমান ও ভবিষ্যত প্রজন্মের অধিকার সংরক্ষণ করবে; আমরা দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, এই সংবিধান প্রতিটি নাগরিককে পরস্পরের প্রতি অধিকার, কর্তব্য ও জবাবদিহিতার চেতনায় সংঘবদ্ধ করবে, সর্বদা রাষ্ট্র পরিচালনায় জনপ্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে, আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযোগিতার নীতিকে অনুসরণ করবে এবং রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব সমুন্নত রাখবে।

কমিশন সংবিধানের মূলনীতি হিসেবে সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক সুবিচার, বহুত্ববাদ এবং গণতন্ত্রকে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছে। বিদ্যমান সংবিধানের দ্বিতীয় ও তৃতীয় ভাগের অধিকারসমূহ সমন্বিত করে ‘মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা’ নামে একটি একক সনদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আদালতে বলবৎযোগ্য হবে এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকার ও নাগরিক, রাজনৈতিক অধিকারের মধ্যে বিদ্যমান তারতম্য দূর করবে।

এছাড়া কমিশন দ্বিকক্ষবিশিষ্ট আইনসভার প্রস্তাব করছে, যেখানে একটি নিম্নকক্ষ জাতীয় সংসদ (ন্যাশনাল এ্যাসেম্বলি) এবং একটি উচ্চকক্ষ (সিনেট) থাকবে এবং উভয় কক্ষের মেয়াদ হবে চার বছর।

উচ্চকক্ষ মোট ১০৫ (একশো পাঁচ) জন সদস্য সমন্বয়ে গঠিত হবে। যার মধ্যে ১০০ জন সদস্য জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রদত্ত মোট ভোটের সংখ্যানুপাতে নির্ধারিত হবে। নিম্নকক্ষ গঠিত হবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে সরাসরি নির্বাচিত সদস্যদের সমন্বয়ে।

একজন সংসদ সদস্য একইসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী, সংসদনেতা কিংবা রাজনৈতিক দলের প্রধান- এই তিনটির যেকোনো একটির বেশি পদে অধিষ্ঠিত হবেন না।

পাশাপাশি অর্থবিল ছাড়া নিম্নকক্ষের সদস্যরা তাদের মনোনয়নকারী দলের বিপক্ষে ভোট দেওয়ার পূর্ণ ক্ষমতা থাকবে এবং আইনসভার স্থায়ী কমিটিগুলোর সভাপতি সবসময় বিরোধীদলীয় সদস্যদের মধ্য থেকে মনোনীত হবেন।

কমিশন আরও সুপারিশ করেছে যে, রাজনৈতিক দলগুলো নিম্নকক্ষের মোট আসনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ আসনে তরুণ-তরুণীদের মধ্য থেকে প্রার্থী মনোনীত করবে এবং সংসদীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ন্যূনতম বয়স হবে ২১ বছর।

সংসদে একজন বিরোধী দল থেকে মনোনীত একজনসহ দুইজন ডেপুটি স্পিকার থাকবেন, এবং সংবিধানের যেকোনো সংশোধনী উভয় কক্ষের দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার অনুমোদন ও পরবর্তীতে প্রস্তাবিত সংশোধনী উভয় কক্ষে পাস হলে গণভোটে উপস্থাপন করার সুপারিশ ও করেছে কমিশন।

রাষ্ট্রীয় কার্যাবলীতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা আনয়ন এবং রাষ্ট্রীয় অঙ্গ ও প্রতিষ্ঠান সমূহের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করার জন্য একটি জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠন এবং আইনসভার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরে কিংবা আইনসভা ভেঙে গেলে পরবর্তী নির্বাচিত সরকার শপথ না নেওয়া পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৯০ দিন মেয়াদের একটি অন্তর্বর্তী সরকার নিয়োগের সুপারিশ করেছে।

সুপারিশে জনদুর্ভোগ নিরসনে উচ্চ আদালতের বিকেন্দ্রীকরণ করে দেশের সকল বিভাগে হাইকোর্ট বিভাগের সমান এখতিয়ার সম্পন্ন হাইকোর্টের স্থায়ী আসন প্রবর্তনের সুপারিশ করছে।

এতে বলা হয়েছে, তবে রাজধানীতেই থাকবে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আসন। এছাড়া বিচার বিভাগকে পূর্ণ আর্থিক স্বাধীনতা দেওয়ার সুপারিশ করছে কমিশন।

সংবিধানে কিছু নতুন অধিকার যেমন খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থান, ইন্টারনেট প্রাপ্তি, তথ্য প্রাপ্তি, ভোটাধিকার ও রাষ্ট্র পরিচালনায় অংশগ্রহণ, গোপনীয়তা রক্ষা, ভোক্তা সুরক্ষা, শিশু উন্নয়ন, বিজ্ঞান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

চেয়ারম্যান ড. আলী রীয়াজের নেতৃত্বে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁও কার্যালয়ে তার হাতে এ প্রতিবেদন তুলে দেন।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্টে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

গত বছরের ৬ অক্টোবরে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক অধ্যাপক আলী রীয়াজকে প্রধান করে সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার।রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক ও আলোচনা শেষে তৈরি করা হয় এ চূড়ান্ত প্রতিবেদন।

এরআগে, চলতি মাসের ২ তারিখে প্রজ্ঞাপন জারি করে কমিশনের মেয়াদ ১৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বাড়ানো হয়। সূত্র: বাসস

Related News