‘এই পদ্মা এই মেঘনা’ গানের রূপকার গীতিকবি ও কণ্ঠশিল্পী অধ্যাপক আবু জাফর
বাংলার নদী, প্রকৃতি ও ভালোবাসা নিয়ে অসাধারণ কিছু কবিতা ও গান রচয়িতা বরেণ্য গীতিকবি, সুরকার, কণ্ঠশিল্পী ও শিক্ষক আবু জাফর আর নেই।
গত শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) ঢাকার এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।
১৯৭০ ও ১৯৮০-র দশকে মানুষের মুখে মুখে ফেরা আবু জাফর রচিত ‘এই পদ্মা এই মেঘনা / এই যমুনা সুরমা নদী তটে...’ বাঙালির হৃদয়কে প্রশান্তিময় করে। মন ও প্রাণ ভরে এই গানটিকে গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের মানুষ।
বিবিসি'র এক জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ ২০টি গানের মধ্যে স্থান পেয়েছে অমর এই গানটি। মন্তব্যে গানটি সংযুক্ত করা হলো।
তাঁর রচিত ‘তোমরা ভুলেই গেছো মল্লিকাদের নাম’ ও ‘নিন্দার কাঁটা যদি না বিঁধিল গায়ে’ গান দুটিও অমরত্ব পেয়েছে বহু আগে। তাঁর রচিত অনন্য সংগীতের মধ্যে আরও রয়েছে ‘আমি হেলেন কিংবা মমতাজকে দেখিনি’, ‘তুমি রাত আমি রাতজাগা পাখি’ প্রভৃতি।
আবু জাফর সাবেক দাম্পত্য সঙ্গী নন্দিত কণ্ঠশিল্পী ফরিদা পারভীনের সাথে যুগলবন্দী হয়ে কণ্ঠ দিয়েছেন স্বরচিত বহু গানে।
গানগুলো জনপ্রিয় হয়েছে চমৎকার উপমা সমৃদ্ধ গানের কথায় গীতল কাব্যময়তা এবং লোকজ সুরের মূর্ছনায়। গানের মৌলিকতা ও তার প্রকাশে। তাঁর গানগুলো যেন একেকটি কবিতা। তাঁর রচিত ও কণ্ঠে দেশাত্ববোধক গান ও আধুনিক গান এক সময়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল।
তিনি রাজশাহী ও ঢাকা বেতার এবং টেলিভিশনে নিয়মিত সঙ্গীত শিল্পী এবং গীতিকার ছিলেন। কবি ও শিল্পী আবু জাফরের জন্ম কুষ্টিয়ার কুমারখালীর চাঁদপুর ইউনিয়নের গড়ের বাড়ি কাঞ্চনপুর গ্রামে। তাঁর পিতার নাম খোন্দকার মো: জমির উদ্দিন।
গুণী এই মানুষটির সাথে আমার দেখা ও আলাপ হয়েছিল মাত্র একবারের জন্য। ১৯৯০ দশকের গোড়ার দিকে।
তখন তিনি কুষ্টিয়া সরকারী কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক। কোনো কাজে ঢাকায় এসে তোপখানা রোডের প্রীতম হোটেলে উঠেছিলেন। জাতীয় প্রেস ক্লাবে আমার সহপাঠী এক বন্ধুর সাথে কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর সেই বন্ধু জানালো কুষ্টিয়া কলেজে তার সহকর্মী আবু জাফরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছে। আমি যাবো কী না।
সুযোগটি হাতছাড়া না করে বন্ধুর সাথে গেলাম অধ্যাপক আবু জাফরের সাথে সাক্ষাৎ লাভের উদ্দেশ্যে। প্রীতম হোটেলে আবু জাফরের কক্ষে ঘণ্টাখানেকের অবস্থানকালে আলাপ হলো নানা বিষয়ে।
তাঁর রচিত গান ও কবিতা নিয়ে আলাপ হয়েছিল কিছু। তবে নিজের সৃষ্টি নিয়ে আলোচনায় খুব বেশি আগ্রহী মনে হয়নি ভাবুক এই গীতিকবি ও শিল্পীকে। তাঁর সহকর্মীদের কয়েকজন আমার স্বজন এবং ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। তাদের নিয়েও কথা হলো।
তিনি বেশ কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে, ‘নতুন রাত্রি পুরনো দিন’ (কাব্য), ‘বাজারে দুর্নাম তবু তুমিই সর্বস্ব’ (কাব্য) ও ‘বিপ্লবোত্তর সোভিয়েত কবিতা’ (অনুবাদ কাব্য)।
যৌবনে সাম্যের অনুরাগী আবু জাফরের প্রথম কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে কলকাতা থেকে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের এই শিক্ষক দীর্ঘকাল কুষ্টিয়া কলেজ ও চুয়াডাঙ্গা কলেজ সহ নানা কলেজে শিক্ষকতা করেন। নমিত কণ্ঠস্বরের অধিকারী অধ্যাপক আবু জাফর মৃদুভাষী ছিলেন। শেষ জীবনে তিনি সঙ্গীত থেকে দূরে সরে গিয়ে ধর্মানুরাগী হিসেবে একেবারেই একান্তে ও নিভৃতে দিন অতিবাহিত করেন। বার্ধক্যজনিত নানা জটিলতায় বেশ কিছুদিন ধরে অসুস্থও ছিলেন তিনি।
চার সন্তান, অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রী ও তাঁর সৃষ্টির অনুরাগী রেখে গেছেন তিনি। শিক্ষার্থীদের মনন, সঙ্গীতাঙ্গন ও কাব্য জগৎকে আলোকিত করা এই গীতিকবি চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন তাঁর সৃষ্টির মধ্য দিয়ে।
সৈকত রুশদী, রাজনৈতিক ও গণমাধ্যম বিশ্লেষক, সাংবাদিক, ব্রডকাস্টার, কবি ও লেখক। জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক যুগ্ম সম্পাদক। বর্তমানে কানাডায় অভিবাসী।