সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার বিষয়ে উচ্চ আদালতের রায়কে কেন্দ্র করে আন্দোলনে নেমেছিল শিক্ষার্থীরা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আওয়ামী লীগ এবং তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের বলপ্রয়োগের ফলে শান্তিপূর্ণ এ আন্দোলন রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে। শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি এ আন্দোলনে অংশ নেন সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ।
শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৫ বছরের ক্ষমতার মসনদ টিকিয়ে রাখতে এ আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। গত ১৯ জুলাই রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারান ২৩ বছরের তরুণ আল শাহরীয়ার হোসেন রোকন (২৩)। পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রোকন ছিলেন ছয় সদস্যের পরিবারের অন্যতম উপার্জনক্ষম সদস্য।
রোকনের হত্যার ঘটনায় পিতা মনির হোসেন বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। কিন্তু থানায় গিয়ে জানতে পারেন তার ছেলে নিহতের ঘটনায় আগেই মামলা হয়েছে। পরবর্তীতে আদালতের মাধ্যমে মামলা করলেও ছেলের হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা হওয়ায় বিচার পাওয়া নিয়ে শঙ্কায় এই শোকাহত পিতা।
রোকনের হত্যার ঘটনায় দুটি মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে তার বাবা বলেন, আমার ছেলে ১৯ জুলাই আন্দোলনে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। রোকন আমার চার সন্তানের মধ্যে বড়। আমি দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ হয়ে ঘরে পড়ে আছি। এই ছেলেই সংসার চালাতো। তাকে হারিয়ে আমাদের অবস্থা এখন খুবই খারাপ। এ দিকে থানায় মামলা করতে গিয়ে দেখি- আমার ছেলের হত্যার ঘটনায় একজন বাদী হয়ে আগেই মামলা করেছেন। অথচ মামলার বাদীকে আমরা চিনি না। সে মামলা করার আগে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগও করেনি। ওই মামলা যাদের আসামি করা হয়েছে, তাদের অনেকেই ঘটনার সময়ে ছিল না। এখন তারা আমাকে নানা ধরনের কথা বলে। কিন্তু আমি তো অসহায়, কার কাছে যাবো; কি করবো; কিছুই বুঝতে পারছি না।
জানাজা ও লাশ দাফনে কোনো বাঁধা ছিল কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার ছেলের জানাজা ও লাশ দাফনে কোনো বাঁধা ছিল না। আওয়ামী লীগের কেউ আসে নাই। ছেলে মারা যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত বিএনপির কেউ খোঁজ না নিলেও শুনেছি বিএনপির এক নেতা আমার ছেলে নিহতের ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন। সেদিন থানায় গিয়েও দেখি পুলিশের বসে আছে। পুলিশ তাকে কত খাতির-যত্ন করছে। অথচ আমার ছেলে হত্যার ঘটনায় জড়িত কাউকে গ্রেফতার করছে না। থানায় গেলে কেউ ভালোভাবে কথাও বলে না।
জানা গেছে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী শাহরীয়ার হোসেন রোকন হত্যার ঘটনায় বাদী হয়ে মামলা করেছেন এক যুবদল নেতা। গত ৩ সেপ্টেম্বর আদালতে বাদী হয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামাল, ঢাকা-১৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাদেক খান, সাবেক কাউন্সিলর রাজিব, আসিফ, আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ সংগঠনের স্থানীয় ওয়ার্ড ও থানা পর্যায়ের নেতাসহ ৬৮ জনের নামে মামলা করেছেন।
এদিকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রোকন হত্যার ঘটনায় পিতা মনির হোসেনের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান কামালসহ ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। এছাড়াও অজ্ঞাত ২০০ থেকে ৩০০ জনকে আসামি করা হয়।
বার্তা২৪.কম’র হাতে আসা মামলার দুটির নথি বলছে রোকন হত্যার ঘটনায় তার পরিবার ও যুবদল নেতা মোহাম্মদপুরের ১০০ নম্বর ওয়ার্ড যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রবিউল খান হিল্লোল বাদী হয়েছেন। দুটি মামলার আবেদন ঢাকার সিএমএম কোর্টে করা হয়। পরবর্তীতে আদালত মামলা দুটির রেকর্ড করতে মোহাম্মদপুর থানাকে নির্দেশ দেন। আদালতে নির্দেশে গত ৩ সেপ্টেম্বর মাত্র ৪৫ মিনিটের ব্যবধানে মামলা দুটি গ্রহণ করেন থানার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান। যদিও সময়ের হিসেব বলছে, রোকনের বাবার মামলাটি একই দিন দুপুর ১২টা ৪৫ মিনিটে গ্রহণ করেন ওসি ইফতেখান। এর ৪৫ মিনিট পর দুপুর ১টা ৩০ মিনিটে যুবদল নেতার মামলাটি গ্রহণ করেন তিনি।
একই ঘটনায় মাত্র ৪৫ মিনিটের ব্যবধানে দুই মামলা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলী ইফতেখার হাসান ফোন ধরেননি। তাকে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুরের জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. তারেক সেকেন্দার বলেন, একই হত্যার ঘটনায় দুটি মামলা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যদি এমন হয়েও থাকে, তাহলে সেটি আমরা আদালতের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি মামলা আরেকটির সঙ্গে একত্র করে দিবো।
তিনি আরও বলেন, আপনি হয় তো জানেন, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে ছাত্র সমন্বয়ক সেঁজে অনেকে মামলা করতে এসেছে। মামলা না নিলে থানা ঘেরাওসহ নানা কর্মকাণ্ড করেছে। তাই হয়তো এমন হতে পারে। বিষয়টা আমরা দেখবো।
পরিবারের অনুমতি ছাড়া মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার বাদীয় ও বলেন, রোকনের পরিবার আর আমার মামলার তারিখ দেখেন। সেদিন আমার সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায় রোকন। তাই আমি মামলা করেছি। তার পরিবার বলেছিল, মামলা করবে না। আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন। আমি নিজেও সেদিন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়েছি। তাই আমি বাধ্য হয়ে মামলা করেছি।
মামলায় জানাজা ও লাশ দাফনে বাঁধার কথা উল্লেখ থাকলেও পরিবার বলছে তারা কোনো বাঁধার সম্মুখীন হননি। এমন প্রশ্নের জবাবে মামলার বাদী হিল্লোল বলেন, আমি গুলিবিদ্ধ হয়েছি। জানাজার সময়েও হেলিকপ্টার দিয়ে গুলি করা হয়। তাহলে বাধা দিলো না কীভাবে। আপনি কি আসামিদের পক্ষ হয়ে সাফাই গাইছেন? এখানে আমার রাজনীতি পরিচয় কেন আনছেন।
এদিকে একই ঘটনায় দুই মামলার গ্রহণ ও তদন্ত প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন বার্তা২৪.কম-কে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আমি খোঁজ নেবো। ওসি এমনটা কেন করলো আমাকে জানতে হবে। একই ঘটনায় দু’টা মামলা হওয়ার কথা না। একটি মামলা হবে। যেহেতু দুইটা মামলা হয়েছে সেক্ষেত্রে পরিবারের মামলাটিরই ফাইনাল রিপোর্ট হবে। তারা আমাদের কাছে আসুক। আমরা তাদের সহযোগিতা করবো।
এমন ঘটনা এড়ানোর সুযোগ ছিল কি-না জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবশ্যই এই ঘটনা এড়ানো যেত। এটার দায়দায়িত্ব ওসিকে নিতে হবে। আগামীকাল ক্রাইম কনফারেন্স আছে, আমি বিষয়টা তুলবো।