বেকারত্ব যখন আমাদের সমাজব্যবস্থার প্রধান অন্তরায়, তখন সেই বেকারত্বের ছাপ মুছে দিতে নিজ দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে ছাত্র অবস্থায় উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন শিক্ষার্থীরা। নানামুখী প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করে তারা এগিয়ে চলেছেন স্বপ্ন পূরণের পথে।
কথায় আছে, ‘যে রাঁধে, সে চুলও বাঁধে’। এই প্রবাদটিকে বাস্তবরূপ দিতে পড়াশোনা আর ব্যবসা দুটোই সামলাচ্ছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) কয়েকজন শিক্ষার্থী। নিজের পড়াশোনার খরচের পাশাপাশি পরিবারও সামলাচ্ছেন তারা।
উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রায় এগিয়ে যাওয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয় এ ব্যাপারে। যারা পড়াশোনার পাশাপাশি সমানতালে তাদের ব্যবসা সামলিয়ে যাচ্ছেন। এদেরই একজন সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী বর্ষা।
তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেন, ‘উদ্যোক্তা হতে খোলামেলা পোষাক বা পরিচিতির প্রয়োজন নেই, ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট। উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন আমার অনেক দিনেরই। এদিকে আমর ব্যাচমেট এবং রুমমেট কক্সবাজারের। তো হঠাৎ চিন্তা করলাম কক্সবাজার জেলার কিছু ঐতিহ্যবাহী পণ্য দিয়ে ক্যাম্পাসে বিজনেস শুরু করলে কেমন হয়? তারপর বান্ধবীর সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম অল্প পুঁজি দিয়ে আপাতত শুরু করি। সে থেকে মাত্র ১০ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে কক্সবাজারের আচার, শুঁটকি, বালাচাও এবং বাদাম নিয়ে ব্যবসা শুরু করি গত সেপ্টেম্বরে। আলহামদুলিল্লাহ, এখন আমি নিজের খরচ নিজেই চালাতে পারি। আমাদের ক্যাম্পাসে মেয়েদের মধ্যে আমরাই প্রথম যারা অনলাইন ও অফলাইনে এ ধরনের ব্যবসা শুরু করেছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যদিও আপাতত এটি ক্যাম্পাসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। তবে ইনশাআল্লাহ, ভবিষ্যতে দেশজুড়ে আমাদের পণ্য ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, ছেলে বা মেয়ে হওয়া কোনো বিষয় নয়; হালাল উপার্জনটাই আসল।’
বর্ষা বলেন, ‘শুরুর দিকে অনেক মানুষের নেতিবাচক কথা শুনতে হয়েছে, এমনকি কাছের মানুষদের থেকেও সাপোর্ট পাইনি। কিন্তু ধৈর্য ধরে নিজের লক্ষ্যে অটল ছিলাম। আজ আমি বলতে পারি, মেয়েরা চাইলে সবকিছু করতে পারে। তবে তার জন্য খোলামেলা পোশাক বা অতিরিক্ত পরিচিতির প্রয়োজন নেই। আমার ক্যাম্পাসের বোনদের প্রতি আহ্বান থাকবে—আপনারাও উদ্যোক্তা হোন। ব্যবসা শুরু করতে বেশি পুঁজি নয়, ইচ্ছাশক্তিই যথেষ্ট।’
আরেকজন ক্ষুদে উদ্যোক্তা সালমান (ছদ্মনাম), বিয়ে করে বউ নিয়েই ক্যাম্পাসের পার্শ্ববর্তী একটি বাসায় ভাড়া থাকেন। এদিকে ক্যাম্পাসের আশেপাশে টিউশনিও তেমন সহজলভ্য নয়। কিন্তু সংসার চালাতে ভালোই খরচাপাতি দরকার হয়। তাই সিদ্ধান্ত নিলেন মানুষের নিত্যদিনের ব্যবহার্য ইলেক্ট্রনিক্স জিনিসপত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে স্টল নিয়ে বসার।
যেই কথা সেই কাজ! শুরুতে কিছুটা সংকোচ বোধ করলেও সময়ের পরিক্রমায় এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছেন তার ছোট্ট ব্যবসায়। ক্লাস চলাকালীন বিশ্ববিদ্যালয়ের ঝাল চত্বরে এবং সন্ধ্যার পর হল সংলগ্ন জিয়া মোড়ে দেখা মেলে তার।
তিনি বলেন, ‘যেহেতু আমি বিবাহিত, তাই আমাকে সংসারের বিষয়ে ভাবতে হয়। তাছাড়া টিউশনি করতে হলে কুষ্টিয়া বা ঝিনাইদহ শহরে যাওয়া লাগে। সেখানে যাওয়া আসায় ২ ঘণ্টা সময় নষ্ট হয়। তার থেকে ভালো আমি যদি ২ ঘণ্টা সময় এখানে দেই, আমার টিউশনি থেকে ভালো টাকা উপার্জন হয়। আমাদের দু’জনের ভালোভাবেই চলে যায়।’
তিনি আরও জানান, ‘শুরুতে আমি যখন উদ্যোগ গ্রহণ করি, তখন কাউকে দেখতাম না। এখন দেখলাম অনেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে এদিকে ঝুঁকছে। কেউ টিশার্ট, কেউ ছোট খাবারের দোকান দিয়ে উদ্যোক্তা হচ্ছেন। আমার পরামর্শ থাকবে, এখান থেকে কেউ উদ্যোগ নিতে পারলে ভবিষ্যতে যে কোনো একটা জায়গায় গেলে সে ভালো করতে পারবে। কারণ এখানে একজন মানুষ তার জীবন সম্পর্কে ধারণা পেতে পারে। তাছাড়া কেউ চাকরি করলে সে অন্যের অধীনে চাকরি করবে, কিন্তু উদ্যোক্তা হলে সে আরেকজনকে চাকরি দিতে পারবে। তাই আমি বলবো- শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হতে এগিয়ে আসতে।
আরেকজন উদ্যোক্তা মিলি (ছদ্মনাম) জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের যে খাবার! তা মানুষের গলা দিয়ে নামতে কষ্ট হয়। সেই হল লাইফের শুরু থেকেই রান্নাবান্না করা হতো। শখের বশেও অনেকসময় রান্নাবান্না করা হয়। তারপর ভাবলাম যে, রান্নাবান্না করে ছোট পরিসরে বিজনেস করলে কেমন হয়! রান্নার প্রশংসা করতো সবাই, সাহসও দিয়েছে যে, ‘এটা দিয়েই শুরু করতে পারিস কিছু একটা!’
‘তারপর আর কি! যেই ভাবা সেই কাজ! আমি আর আমার বান্ধবী দু’জনে সিদ্ধান্ত নেই যে, রান্নাবান্না করে বিক্রি করার। এদিকে মেয়েদের হলের সামনে সেরকম খাবারের দোকান নেই। আর ক্যাম্পাস জুড়ে সেরকম ভ্যারিয়েশন ও নেই খাবারের।’
তিনি জানান, প্রথম একদিন সাহস করে প্রি অর্ডার নিয়ে ফেলি খাবারের৷ ‘নান আর চিকেন’ সাথে চিকেন বার্গার এবং স্যানডউইচ। এতো বেশি সাড়া পাই অকল্পনীয় ছিল! তারপর থেকে সবার ভলোলাগা আর চাহিদা বাড়তে থাকে। এরপরে সাহস করে হলের সামনেই নিজেদের ছোটখাটো একটা স্টল দিয়ে ফেলি! শীতে গরম গরম চিকেন স্যুপ, চিকেন চাপ। পাশাপাশি লুচি-ডালের স্বাদে, সুবাসে আমাদের ছোট্ট স্টলের সামনে জমতে শুরু করে মানুষের ভিড়। এমন ও হয় এখন আমরা স্টলে বসার আগে থেকেই অনেকে এসে অপেক্ষা করে, যাতে আগে থেকে খাবার পায়। অনেক প্রেশার হয় তখন কিন্তু অদ্ভুত একটা ভালো লাগা কাজ করে যখন তৃপ্তি নিয়ে সকালকে খেতে দেখি। এটাই প্রাপ্তি।
নতুনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, একটা কথাই বলবো, যে যে বিষয়ে দক্ষ সে বিষয়ে পণ্যের মান আর কাস্টমারের চাহিদা বুঝে বিজনেস শুরু করুন। আর অবশ্যই কোয়ান্টিটি নয়, কোয়ালিটিতে ফোকাস করুন।
ইবির আরেকজন ক্ষুদে উদ্যোক্তা ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষার্থী মো. মাসুদুর রহমান।
তিনি বলেন, আল্লাহ তায়ালা ব্যবসাকে হালাল এবং সুদকে করেছেন হারাম। তাছাড়া রাসুল (স.) নিজেও একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। তিনি তার উম্মতকে সৎ উপায়ে হালাল পদ্ধতিতে ব্যবসার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছেন। পৃথিবীতে সবচেয়ে বরকতময় পেশার একটি হলো ব্যবসা। সৎ ব্যবসায়ীকে আল্লাহ তায়ালা শহীদের মর্যাদা দিবেন। সেই থেকে উদ্বুদ্ধ হয়ে আমি ছোট্ট পরিসরে ব্যবসাটি শুরু করলাম।
মাসুদুর রহমান বলেন, এখানে আমি ২ টাকা পিস সিঙ্গাড়া, ৫ টাকা পিস গুলগুলা, ১০ টাকা প্লেট ছোলা দিয়ে শুরু করেছি। আমি যেহেতু ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং এর স্টুডেন্ট, আমার পড়াশোনার বিষয়ও ছিল ব্যবসা কেন্দ্রিক। তাই নিজের অভিজ্ঞতাটা চাকরি ক্ষেত্রে না লাগিয়ে ব্যবসায় কাজে লাগালাম।
নতুনদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, তাদের নিজেকে আগে প্রশ্ন করতে হবে সে আসলে কী চায়? জোর করে বা হুজুগে কিছু হয় না। যদি মনে করে কেউ তাকে ব্যবসা টানছে তাহলে সে এদিকে আসুক৷ আর যদি মনে করে চাকরি করবে তাহলে সেদিকেই যাক।