কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে রিগ নেওয়ার খরচ ৪২ লাখ ডলার

, অর্থনীতি

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-10-21 09:42:41

গ্যাজপ্রমের জন্য ফরমায়েশি ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) খরচ বাড়াতে উদ্ভট সব খাত যুক্ত করার নজির দেখা গেছে। এমন সব খাতে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে, যার কোন বাস্তবতা ছিল না।

ভোলায় যখন রিগ বিদ্যমান সেখানে নতুন কূপ খনন (টবগী, ভোলা নর্থ-২ এবং ইলিশা) প্রকল্পে রিগ মোবিলাইজেশনের জন্য ৪ দশমিক ২৫ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ রাখা হয়। ভোলায় যে রিগটি তখন অবস্থান করছিল তার সাক্ষ্য দিচ্ছে বাপেক্সের চিঠি। ২০১৭ সালে ভোলা নর্থ কূপ খনন করার পর বাপেক্সের ইয়ার্ডে রিগ রেখে দেয় গ্যাজপ্রম। রিগটি সরিয়ে না নেওয়া বাপেক্সের পক্ষ থেকে ইয়ার্ড ভাড়া দাবি করে চিঠি দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। ইয়ার্ড ভাড়া আদায় থাকা তো দূরের কথা উল্টো একই সময়ে টবগী, ভোলা নর্থ-২ এবং ইলিশা কূপ খননের ডিপিপিতে অস্বাভাবিক বরাদ্দ রাখা হয়।

সবকিছু জানা থাকার পরও শুধুমাত্র বেশি খরচ মেলানোর জন্য মোবিলাইজেশন খরচ ধরা হয় ৪.২৫ মিলিয়ন ডলার। মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে নিতে ওই খরচ যুক্ত করা হয় ডিপিপিতে। শুধু ওই প্রকল্পে অন্যান্য প্রকল্পেও সকল নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে গ্যাজপ্রমকে কাজ দিয়েছে আওয়ামী লীগ সরকার।

সাধারণত কোন প্রকল্পের কাজের ধরণ ও মালামাল ক্রয়ের খরচ বিবেচনায় ডিপিপি চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু গ্যাজপ্রমের ক্ষেত্রে হয়েছে কতটাকা দিতে হবে সে মোতাবেক ফরমায়েশি ডিপিপি। গ্যাজপ্রমকে বিনা দরপত্রে দেওয়া কূপ খননের কাজের ক্ষেত্রে দর নির্ধারণ হতো মন্ত্রণালয়ে বসে। পরে সে অনুযায়ী প্রত্যেকটি কূপেই ১০০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা বেশি দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। আর সেই খরচের অংক মেলাতে আজগুবি সব খাত দেখানো হয়েছে।

দরপত্র ছাড়া বিশেষ আইনে গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সম্পাদিত সবগুলো চুক্তি যাচাই-বাছাই করার দাবি উঠেছে। চড়া দরে দেওয়া দরপত্রে দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। লুটপাটে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচন করতে বিশেষ আইনে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাপেক্স সূত্র জানিয়েছে, শুধু রিগ মোবিলাইজেশন খাত নয় আরও অনেক বিষয়ে জালিয়াতি করা হয়েছে টবগী, ভোলা নর্থ-২ এবং ইলিশা কূপ খনন প্রকল্পে। আগের কূপগুলোর তুলনায় ভোলার ওই তিনটি কূপের গভীরতা কম হলেও দর ধরা হয় অনেক বেশি। গ্যাজপ্রম শাহবাজপুর কূপ#৩ ও কূপ#৪ খনন করেছে। এগুলোর গভীরতা ছিল ৪ হাজার মিটার (এমডি)। আর টবগী, ভোলা নর্থ-২ এবং ইলিশার গভীরতা ছিল প্লাস-মাইনাস ৩৪৫০ মিটার। প্রায় ৫০০ মিটার গভীরতা কমলেও দর বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে।

আওয়ামী লীগের শাসনামলে গ্যাজপ্রমকে চড়াদরে কাজ দেওয়ার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় যে কূপ খনন করতে পারে, একই কূপ খননে ২২০ দেওয়া হয়েছে গ্যাজপ্রমকে। এভাবে ১৯টি কূপ খননে রাষ্ট্রের কয়েক হাজার কোটি টাকা ভাগ বাটোয়ারা করা হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কূপ খননে যা হয়েছে তাকে মহাসাগর ডাকাতি বলা যায়। তিনগুণ পর্যন্ত বিল দেওয়া হয়েছে বিনা দরপত্রে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র নিশ্চিত করা গেলে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেঁচে যেতো।

আর যে কাজ রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স করতে পারে সেই কাজ চড়া দরে ঠিকাদারকে দিতে হবে কেনো এমন প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, যেখানে বাপেক্স কাজ করতে সক্ষম সেখানে বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। বাপেক্সের কূপ গ্যাজপ্রমকে দিয়ে করানোর কোন যৌক্তিকতা দেখি না। কেনো বিদেশি কোম্পানি দিয়ে করাতে হলো এটা নিয়েও তদন্ত হওয়া উচিত।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলার কথা বলে ২০১০ সালে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বিধান বৃদ্ধি (বিশেষ আইন) আইন’ প্রণয়ন করে সরকার। শুরুতে দুই বছরের জন্য আইনটি করা হলেও দফায় দফায় মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। আইনটির ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘এই আইনের অধীনকৃত বা কৃত বলিয়া বিবেচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।’

বিশেষ আইন ব্যবহার করে মোট ১৯টি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় যে কাজ করতে পারে, একই কূপ সোয়া ২০০ কোটি টাকায় দেওয়া হয়েছে। গাজপ্রমকে যখন কূপ প্রতি ২০০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়, ওই সময়ে বাপেক্স রূপগঞ্জ (২০১৫ সাল) কূপ খনন করেছে ৬১ কোটি টাকা খরচে। ওই প্রকল্পের ডিপিপিতে প্রাক্কলিত দর ছিল ৯৭ কোটি টাকা, সেই কাজ বাপেক্স ৬১ কোটি টাকায় শেষ করে বাকি টাকা ফেরৎ দিয়েছে। শ্রকাইল ইস্ট-১ ও সালদা নর্থ-১ (২০১৬ সাল) কূপ দুটি খননে ব্যয় হয়েছে ১৪৪ কোটি টাকা। এতে করে কূপ প্রতি খরচ পড়েছে ৭২ কোটি টাকা।

গ্যাজপ্রমের কমিশন ভোগীরা বিভিন্ন রকম যুক্তি দাঁড় করানোর চেষ্টা করেন। তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়ে থাকে, বাপেক্স যেহেতু নিজের রিগ ব্যবহার করেছে সে কারণে রিগ ভাড়া দিতে হয় নি, তাই খরচ কম। রিগ ভাড়া যোগ করলে ধারের কাছে নেই গ্যাজপ্রমকে দেওয়া দর। একটি কূপ খনন করতে আদর্শ সময় বিবেচনা করা হয় ৪৫দিন (যদিও ৩০ দিনে শেষ হয়ে থাকে) সে হিসাবে রিগ (দৈনিক ভাড়া ২০ হাজার ডলার/১২০ টাকা) ভাড়া দাড়ায় ১০ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ সবমিলিয়ে দাঁড়ায় ৮২ কোটি টাকা ।

হাতে যখন এই পরিসংখ্যান তখন টবগী, ভোলা নর্থ-২ এবং ইলিশা কূপ খননে ৬২ মিলিয়ন ডলারে চুক্তি করা হয়। যা বাংলা টাকায় তখন পড়েছিল সোয়া ২০০ কোটি টাকার মতো। বিভিন্ন সময়ে এভাবে কয়েকগুণ বেশি দরে ১৯টি কূপের কাজ দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। আরও ১৫টি কূপ খনন প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বাপেক্সের ভোলা গ্যাসফিল্ডের ৫টি কূপ খনন প্রকল্প।

ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আরেকটি মিটিং হলেই চূড়ান্ত হতো। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে জাতি রক্ষা পেয়েছে অপচয় থেকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব নিয়েই বিশেষ আইনে প্রক্রিয়াধীন থাকা প্রকল্প স্থগিত করে দিয়েছেন। যদিও গ্যাজপ্রমের এ দেশীয় এজেন্টরা এখনও হাল ছাড়েন নি, তারা নানাভাবে তদবির অব্যাহত রেখেছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরল নজির গড়েছে গ্যাজপ্রম। গ্যাজপ্রমের বাংলাদেশি এজেন্টরা দিনে দিনে দানবে পরিণত হয়েছিল। তাদের চাপে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বাপেক্সের প্রাণ যায়-যায় অবস্থা হয়েছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ আইনে কূপ খননের কাজ দিতে তাড়াহুড়ো ছিল চোখের পড়ার মতো।

প্রস্তাবিত ১৫টি কূপে প্রতিটিতে ২৩ মিলিয়ন ডলার হারে (১২০ টাকা) প্রায় ৪২০০ কোটি টাকায় চুক্তি করতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। ওই কাজগুলো বাপেক্স দিয়ে সর্বোচ্চ ১২০০ কোটি টাকায় করা সম্ভব। যার ভুরিভুরি নজির দেশের মধ্যেই বিদ্যমান, তারপরও চোখ বন্ধ করে ধারাবাহিকভাবে চড়া দরে কাজ দেওয়া হয়েছে।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমনও সব নজির রয়েছে যা একইসঙ্গে ভয়ানক বলা যায়। তবুও সেই ভয়াবহ কাজ করে গেছেন তৌফিক ই-ইলাহী চৌধুরী সিন্ডিকেট। ২০১৪ সালে বাপেক্সের ৩৫৪তম বোর্ড সভায় শ্রীকাইল-৪ কূপ খননের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ৫৫৬তম বোর্ডসভায় ৬৪টি কোটি টাকার ডিপিপি (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব) অনুমোদন করা হয়। অনুমোদিত ডিপিপি পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করে। নিয়ম হচ্ছে পেট্রোবাংলা অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ শুরু হবে।

কিন্তু পেট্রোবাংলায় ৬৪ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন না দিয়ে ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি প্রেরণ করার ফরমায়েশ দেওয়া হয়। বাধ্য হয়ে একই কাজের (একই গভীরতা) জন্য ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি করা হয়। আর সেই কাজটি দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে।

এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন ন্যাশনাল গ্রুপের চেয়ার‌ম্যান রাশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশী আব্দুস সাত্তার মিয়া (মিয়া সাত্তার)। রহস্য মানব মিয়া সাত্তার এক সময় রাশিয়ার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আওয়ামী লীগের উপরে মহলে দহরম মহরম থাকায় যা খুশি তাই করেছেন। অনেক বিতর্ক হলেও তার অপকর্ম থেমে থাকেনি।

গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে আওয়ামী লীগে পক্ষে জনমত গড়তে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন মিয়া সাত্তার। রাশিয়াতে ”বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি” গঠন করে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের আয়োজন করেন। এসব সেমিনার থেকে আমেরিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলা হয়। ওই সব আয়োজনে নেপথ্যে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি। তারই পুরস্কার হিসেবে নির্বাচনের পর চড়া দরে আরও ১৫টি কূপ খননের কাজ দিতে যাচ্ছিল আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের পতনের পর ভোল পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছেন মিয়া সাত্তার।

গ্যাজপ্রমের বাংলাদেশ অফিসের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করা হলে তারা কোন মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন কর্মকর্তা বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমি সম্প্রতি যোগদান করেছি, রিগ মোবিলাইজেশনের বিষয়টি আমার যোগদানের পুর্বের, সে কারণে বিষয়টি আমার জানা নেই।

দ্বীপজেলা ভোলায় ৯টি কূপ রয়েছে, এগুলো থেকে প্রায় ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা সম্ভব। সেখানে গ্যাসের চাহিদা নেই, আবার মূল ভূখন্ডে আনার পাইপলাইন না থাকায় দৈনিক মাত্র ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে। ২০১৭ সাল থেকে বেকার পড়ে রয়েছে কয়েকটি কূপ সেই ভোলায় দ্রুত সরবরাহ আইনে চড়াদরে ৫টি কূপ খনন প্রকল্প কার স্বার্থে গ্রহণ করছে এমন প্রশ্ন তুলেছেন সংশ্লিষ্টরা। দেশের স্বার্থ নয়, এই প্রকল্প রাশান কোম্পানি গ্যাজপ্রমের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন অনেকেই। যখন গ্যাজপ্রমকে দিয়ে টবগী ও ভোলা নর্থ (বসে থাকা কূপ) খনন করার হয় তখনও আপত্তি উঠেছিল। তখন বলা হয়েছিল এসব কূপ এখন খনন করে কোনো লাভ নেই। তখন সংশ্লিষ্টদের এমন আপত্তি সত্ত্বেও কূপ দু’টি অস্বাভাবিক চড়া দরে খনন করা হয়।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বার্তা২৪.কমকে বলেন, ভোলার কূপ খননের বিষয়টি বাংলাদেশের জ্বালানি চাহিদার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। নাইকোকে যেমন বিশেষ ব্যাক্তিদের লাভ-লস হিসেবে করে কাজ দেওয়া হয়েছিল, এখানে তেমনি হয়েছে। এখানে বিশেষ ক্ষমতা আইনকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ১০ টাকার কাজ একশ টাকায় দেওয়া হচ্ছে এমন অরাজকতার দৃষ্টান্ত বিশ্বের কোথাও খুজে পাওয়া যাবে না। গ্যাজপ্রমকে কাজ দিতে যে সব অন্যায় করা হয়েছে সেগুলো ফৌজদারি অপরাধ, এগুলোর জন্য ফৌজদারি আইনে বিচার হওয়া উচিত।

Related News