অবশেষে ঢাকার দর্শক দেখতে পেলো মৃণালরূপী চঞ্চল চৌধুরীকে। সৃজিত মুখার্জি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম শক্তিমান নির্মাতা মৃণাল সেনকে নিয়ে ছবি করবেন আর তাতে অভিনয় করবেন চঞ্চল চৌধুরী, তা জানার পর বাংলাদেশি দর্শকের মধ্যে দারুণ এক্সাইটমেন্ট কাজ করেছিলো।
একইসঙ্গে দুই দেশে ছবিটি মুক্তির কথা থাকলেও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের ফলে সেটি আর সম্ভব হয়নি। এমনকি চঞ্চল নিজেও তার ছবি মুক্তির সময় কলকাতায় যেতে পারেননি ভিসা জটিলতার কারণে।
কিন্তু ঢাকা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব ঢাকার দর্শকের আকাক্সক্ষা পূরণ করলো। গতকাল (বৃহস্পতিবার) জাতীয় যাদুঘর মিলনায়তনে প্রদর্শীত হলো চঞ্চলের ‘পদাতিক’। ছবিটি একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে দেখেছে দর্শক।
চঞ্চল বরাবরই তার অভিনয় নিয়ে মুগ্ধ করেন। প্রতিটি চরিত্রে তিনি নিজেকে ভিন্নভাবে দর্শকের সামনে হাজির করেন। কিন্তু মৃণাল সেনের চরিত্রে যেন সহজাত অভিনয়টাই করলেন তিনি। মনে হয়, চরিত্রটি হয়ে উঠতে তার খুব বেশি এফোর্ট দিতে হয়নি। মৃণালের বিভিন্ন বয়সকে কী অনায়াসেই না ধারণ করেছেন তিনি। বিশেষ করে অতি বার্ধক্যকালে চঞ্চলের বাচিক ও আঙ্গিক অভিনয় ছিলো দেখার মতো। সাদাকালো ছবিটিকে নির্মাণশৈলীর যাদুতে দারুণ গ্ল্যামারাস করে তুলতে সক্ষম হয়েছেন সৃজিত মুখার্জি।
এবার আসা যাক ছবির গল্পে। ‘আমি যে ধরনের ছবি করতে চাই, তাতে বাধা প্রচুর। পাহাড় প্রমাণ বাধা, পদে পদে বাধা। টাকাওয়ালা প্রোডিউসারকে আমার পছন্দ মতো ছবি করতে রাজি করানো দুঃসাধ্য ব্যাপার। ৪-৫ বছর আগেও দেখেছি, আমি এক একটা ছবি করেছি, তাতে হয়তো আমার মন ভরেছে, কিন্তু পরের ছবি করবার সুযোগ ততই কমে আসছে, কারণ সে ছবিও ফ্লপ করেছে। প্রোডিউসার শিউরে ওঠেন, গুটিয়ে যান। আমি যে বই করতে চাই, সত্যি বলতে কী, তা সকলের ভাল লাগবে না। আমার ছবির নির্বাচিত দর্শক আছে। সারা পৃথিবীর সেই নির্বাচিত দর্শককে একত্রিত করতে পারলেই আমার ছবি করা সার্থক।’
নিজের ফিল্ম মেকিং নিয়ে এমন কথাই অতীতে লিখেছিলেন কিংবদন্তি মৃণাল সেন। একদিনে তিনি কিংবদন্তি হয়ে যাননি। এই কাজের সামান্য পরিচিতি আর ঠিকঠাক প্রযোজক পেতেই তাকে অনেক ঘাম, রক্ত ঝরাতে হয়েছিল। মৃণাল সেনের ফরিদপুরের ছাত্রজীবন থেকে কলকাতা শহর তথা বিশ্বব্যাপী এক কিংবদন্তি হয়ে ওঠার জীবন্ত-দলিল সৃজিত মুখোপাধ্যায় তুলে ধরেছেন তার ‘পদাতিক’ ছবিতে।
সৃজিতই প্রথম পরিচালক, যিনি প্রথম মৃণাল সেনকে মূলস্রোতে আনলেন। ‘পদাতিক’ সর্বস্তরের মানুষকেই ভাল লাগা দেবে। যারা মৃণাল সেনের ছবি দেখতে আগ্রহ পান না, তাদেরও মৃণাল সেনের ছবি ভালবাসতে শেখাবে সৃজিতের ‘পদাতিক’। মানুষ মৃণাল সেনকে চেনাবে। শুধুই এক নাকউঁচু পরিচালক হিসেবে নয়, এক স্ট্রাগলার হিসেবেও।
হেরে যেতে যেতে জিতে যাওয়ার গল্প ‘পদাতিক’। কখনও প্রেমিক মৃণাল সেন, কখনও বা স্বামী মৃণাল, বাবা মৃণাল, বন্ধু মৃণাল কখনও বা পরিচালক মৃণাল। সব রূপে ধরা দিয়েছেন তিনি এই ছবিতে। সৃজিত নিজেই এই ছবির সংলাপ লিখেছেন।
মৃণাল সেনের স্ট্রাগল থেকে একের পর এক উত্থানও উঠে এসেছে ছবিতে। উত্তম ভক্তরা বলে থাকেন, উত্তমকুমার মৃণাল সেনের শাপে-নেউল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু উত্তমকে ভিলেন বানাননি সৃজিত। মৃণাল সেন একমাত্র পুত্র কুণালের জন্মের সময়ও উত্তম-সাবিত্রীর ‘রাতভোর’ ছবির শুটিং করছিলেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের প্রযোজনায়। উত্তম নিজের স্টারডম দূরে সরিয়ে সেদিন কাজ প্যাক আপ করিয়ে নিজের গাড়ি মৃণাল সেনকে দিয়ে দেন স্ত্রীর কাছে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য।
তরুণ মৃণাল কোরক সামন্ত যতটা সাবলীল, পরিণত ও ঝকঝকে, বৃদ্ধ মৃণালের ভূমিকায় চঞ্চল চৌধুরীও তেমনই অনন্য। পরিণত বয়সের চঞ্চল হাঁটা, চলা সবটাই যেন মৃণাল সেন। এমনকি তিনি নিজকণ্ঠেই চলচ্চিত্রের পদাতিক হয়ে উঠেছেন। ততটাই তার পাশে উজ্জ্বল মনামী ঘোষ। কে বলবে, এই মনামীই নাকি সোশ্যাল মিডিয়ার সেনসেশন! মনামীর জীবনে গীতা সেন চরিত্রটি বড় দামি এক মাইলস্টোন।
মানিক্য রায় অর্থাৎ সত্যজিত রায়ের ছবিতে তরুণ জিতু কমল যুবক ও বৃদ্ধ দুই রূপেই ধরা দিয়েছেন। জিতুর বয়স্ক সত্যজিৎ মেক আপ এই প্রথম। জিতু সৃজিতের পরিচালনাতেও অনবদ্য। ‘পদাতিক’ একটা বিশাল সময়কে ধরেছে ছবিতে। বহু বিখ্যাত মানুষের বহু ঘটনা ও তারা স্বয়ং ছবিতে উপস্থিত।
প্রথমেই বলতে হয় রবীন্দ্রনাথের (অলোকেশ ভট্টাচার্য) শোকমিছিল, সঙ্গে সাহানা বাজপেয়ীর কণ্ঠে অনবদ্য গান ‘সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা’। দেখানো হল রবীন্দ্রনাথের দাড়ি ছিঁড়ে নেওয়ার ঘটনাও। জওহরলাল নেহেরু, ইন্দিরা গান্ধী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নিমাই ঘোষ, তরুণ অমিতাভ বচ্চন, উত্তম কুমার, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অঞ্জন দত্ত, শর্মিলা ঠাকুর, রঞ্জিত মল্লিক, সাবিত্রী চ্যাটার্জিসহ অনেক বড় বড় তারকা এসেছেন পুরনো দিনের ছবির দৃশ্যে। ছবির কিছু দৃশ্য দাগ কাটে গভীরে, যেমন মৃণাল-গীতার সংসারে হঠাৎই শেষ অবস্থায় ঋত্বিক ঘটকের (সত্রাজিৎ সরকার) লুচি-আলুরদম খেতে চলে আসা।
চলচ্চিত্রের তিন দেবতাকেও মেলালেন সৃজিত। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, ঋত্বিক ঘটক মারা গেছেন, হাসপাতালে তার খাটের দু’দিকে দাঁড়িয়ে মৃণাল ও সত্যজিৎ। মৃণাল-সত্যজিতের শেষ বেলার আড্ডাটিও মন ছুঁল, দেখে মনে হচ্ছিল, মৃণাল সেন পূর্ণ জীবন বেঁচেছেন। আর ক’বছর বাঁচলেই তিনি শতায়ু হতেন। বেশিদিন বাঁচার কারণে তাকে বন্ধুদের মৃত্যু, সহকর্মীদের মৃত্যু, শালা অনুপ কুমারের মৃত্যু, স্ত্রী গীতার মৃত্যু- সব যন্ত্রণা দেখতে হয়েছে।
‘পদাতিক’ ছবির শক্তিশালী আরেকটি দিক হলো আবহ সঙ্গীত। এই প্রথম সোনু নিগম ও অরিজিত সিং- দু’প্রজন্মের বিখ্যাত গায়ক দ্বৈত সঙ্গীত গাইলেন সলিল চৌধুরীর ‘তু জিন্দা হে’ হিন্দি গণসঙ্গীতে। এই গানের দৃশ্যে চঞ্চল চৌধুরীর অভিনয় গায়ে কাঁটা দেয়। ছবির শেষেও রক্ত গরম করে দেয় কবীর সুমনের কণ্ঠে ‘জনতার হাতে হাতে’। রূপঙ্করের কণ্ঠে ‘ও আলোর পথযাত্রী’ বহুদিন মানুষের মনে থাকবে। আবহ সংগীতায়োজনে ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত।