লক্ষ্মীপুরে চুলায় জ্বলছে না আগুন, পানিবন্দী লক্ষাধিক মানুষ

, জাতীয়

মীর ফরহাদ হোসেন সুমন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, লক্ষ্মীপুর | 2024-08-23 13:21:53

লক্ষ্মীপুরে জলাবদ্ধতার কারণে জেলার মেঘনা উপকূলীয় কমলনগর ও রামগতি উপজেলার পূর্বাঞ্চলে লক্ষাধিক মানুষ ২০-২২ দিন ধরে পানিবন্দী হয়ে রয়েছে। এতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন পার্শ্ববর্তী নোয়াখালী জেলার চরমটুয়া ও আন্ডারচর ইউনিয়নের বাসিন্দারাও। অধিকাংশ বাড়িতেই হাঁটু পরিমাণ পানি জমে থাকায় রান্না করতে পারছে না। 

শুক্রবার (২৩ আগস্ট) সরেজমিন সদর উপজেলার ভবানীগঞ্জ, কমলনগর উপজেলার চরকাদিরা ইউনিয়নের চরঠিকা গ্রাম (স্মার্ট ভিলেজ), রামগতি উপজেলার চরবাদাম ও চরপোড়া গাছা ইউনিয়ন ঘুরে পানিবন্দি বাসিন্দাদের দুর্দশার এ চিত্র দেখা যায়।

তবে পানিবন্দি এলাকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, অবৈধ দখলদারদের কাছ থেকে খালবিল মুক্তকরণসহ অবৈধ বাঁধ অপসারণ করলেই জলাবদ্ধতা রোধ হবে। এরজন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে জোরালো পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

কমলনগরের চরকাদিরা ইউনিয়নের ভুলুয়া নদী এলাকা ঘুরে দেখা যায়, ভুলুয়া নদীতে পানি থৈ থৈ করছে। যদিও শুষ্ক মৌসুমে এ নদীর বিস্তির্ণ এলাকায় কোন পানি দেখা যায় না। বৃষ্টির পানি জমে ভুলয়া এখন পানিতে টইটম্বুর। একইসঙ্গে আশপাশের বিস্তির্ণ এলাকাও ডুবে আছে বৃষ্টির পানিতে। অধিকাংশ বাড়িতেই হাঁটু পরিমাণ পানি জমে আছে। আবার অনেক বাড়িতে কোমর পরিমাণ পানি, ঘরেও ঢুকে পড়েছে। সেখানকার মানুষ উঁচু এলাকায় আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। তবে কেউই সাইক্লোন শেল্টার বা আশ্রয়ণ কেন্দ্রে যায়নি।

রামগতির চরবাদাম ইউনিয়নের বেড়িবাঁধ এলাকার পূর্ব পাশে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। যতদূর দেখা যায়, সব পানি আর পানি। গণকবরস্থান ডুবে আছে। যেখানে প্রায় ৭ ফুট পানি রয়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। সেখানকার প্রত্যেকটি ঘরের ভেতর ৪-৫ ফুট পানিতে ডুবে আছে। এতে ঘরছাড়া কয়েকশ পরিবার। এরমধ্যে এক বৃদ্ধকে দেখা গেছে গরুর জন্য কলার ভেলা ভাসিয়ে বাড়ি থেকে বেড়ি এলাকায় খড় নিয়ে আসতে। পানিবন্দি এসব এলাকায় সাপের ভয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

রামগতির চরপোড়াগাছা ইউনিয়নের চরপোড়াগাছা গ্রামের শেখের কিল্লা এলাকায় গিয়ে শতাধিক বাড়িতে হাঁটু পরিমাণ পানি দেখা যায়। এরমধ্যে আবদুল মজিদ ড্রাইভারের বাড়ি কোমড় পরিমাণ পানিতে ডুবে আছে। ওই বাড়ির বাসিন্দা ঝর্ণা বেগম ও আরিফ হোসেনসহ কয়েকজন তাদের পানিবন্দি হয়ে দুর্দশার কথাগুলো বলেন। এরমধ্যে ঝর্ণা বেগম বলেন, একমাস আগ থেকে প্রায় প্রতিদিন চরপোড়াগাছায় বৃষ্টি শুরু হয়। এতে ২২ দিন ধরে তাদের বাড়ির উঠানসহ আশপাশের এলাকায় পানি জমতে শুরু করে। গত ৫ দিনের টানা বৃষ্টিতে বাড়ির সামনেসহ আশপাশে কোমড় পর্যন্ত পানি জমে আছে। একটুও পানি নামছে না। বাড়িতে হাঁটু পরিমাণ পানি। আমাদের ঘরে আরও ৫টি পরিবাকে আশ্রয় দিতে হয়েছে। গত কয়েকদিন ইট বসিয়ে রান্না করতে হয়েছে। এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। পানির কারণে আগুন জ¦লছে না। কেউ তাদের খোঁজ নিতেও যায়নি।


ওই বাড়ির বাসিন্দা আরিফ হোসেন বলেন, ২২ দিন ধরে আমরা খুব কষ্টে আছি। চারপাশের পানিতে বাড়ি থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। বাচ্চাদেরকে সামলানো মুশকিল হয়ে পড়ছে।

জানতে চাইলে শাহজাহান, ফারুক, কুলসুমা বেগম ও ইমরান হোসেনসহ কয়েকজন জানায়, ভুলুয়া নদী বেদখল আর অবৈধ বাঁধের কারণে পানি জমে আশপাশের গ্রামগুলো ডুবে গেছে। এ নদীতে স্রোত থাকলে পানি নেমে যেত। কিন্তু নদীতে স্রোত নেই, জলাবদ্ধতার প্রধান উৎস হয়ে উঠেছে ভুলুয়া। কয়েকটি স্থানে অবৈধ বাঁধ কেটে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পানির কারণে পুরোপুরি কাটা সম্ভব হয়নি। এছাড়া নদীটির দক্ষিণে চরবাদাম ইউনিয়ন সীমানা শেষ হলেই চরপোড়াগাছা ইউনিয়নে নদী দখল করে ঘর উঠানো হয়েছে ও বাঁধ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই বাঁধ কাউকে সরাতে দেওয়া হচ্ছে না। এভাবে বহু প্রভাবশালীর বেদখলে থাকায় নদীতে পানি প্রবাহ নেই। নামে নদী হলেও এটি এখন মানুষের জন্য মৃত্যু ফাঁদ। অবৈধ দখলদার ও বাঁধগুলো অপসারণ করলেই এ নদীতে প্রবাহ ফিরে আসবে। জলাবদ্ধতাও নিরসন হবে। মানুষ শান্তিতে বসবাস করতে পারবে। এজন্য সবাই সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কাছে সর্বোচ্চ সহযোগীতা চেয়েছেন।

চরপোড়াগাছা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আমিন বলেন, আমার ইউনিয়নের আজাদনগরের দক্ষিণে স্টিল ব্রিজ এলাকায় নদী দখল করে কয়েকটি ঘর উঠানো হয়েছে। ঘরগুলোর কারণে পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া নোয়াখালীর সুবর্ণচরের চরজব্বর ইউনিয়নে নদীটির তিনমুখী একটি এলাকায় পানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। একইসঙ্গে আমার ইউনিয়নের কোডেক বাজার এলাকায় সম্প্রতি একটি ব্রিজ হয়েছে। এতে ব্রিজের দুই পাঁশে বাঁধ দিতে হয়। কিন্তু বাঁধগুলো পুরোপুরি অপসারণ করা হয়নি। এখন তা পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে বাঁধগুলো অপসারণ করা সম্ভব হচ্ছে না। স্থানীয়রা আমার বিরুদ্ধে বাঁধ দেওয়ার অভিযোগ তুলেছে। উপজেলা প্রশাসনের লোকজন এসে দেখে গেছে, আমার বিরুদ্ধে অভিযোগের কোন সত্যতা পায়নি।

চেয়ারম্যান নুরুল আমিন আরও বলেন, প্রায় ২০ দিন ধরেই আমার এলাকার বহু মানুষ পানিবন্দি। অনেকের ঘরে পানি ঢুকে পড়েছে। এতে লোকমান নগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ ৩ টি সাইক্লোন শেল্টারে অর্ধ-শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পানিবন্দি পরিবারগুলোর মাঝে শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে।

লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিদ-উজ জামান খান বলেন, নদীতে ভাটা আসলে জলাবদ্ধতা নিরসনে সবগুলো স্লুইস গেইট খুলে দেওয়া হয়। আবার জোয়ারের সময় গেইটগুলো বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। সার্বক্ষণিক আমাদের কর্মীরা পর্যবেক্ষণে রয়েছে।

লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসক (ডিসি) সুরাইয়া জাহান বলেন, জেলায় জলাবদ্ধতায় প্রায় ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। বুধবার (২১ আগস্ট) থেকে শুকনো খাবার বিতরণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া আমাদের স্থায়ী ও অস্থায়ী ১৮৯ টি সাইক্লোন শেল্টারগুলোও প্রস্তুত রয়েছে। খালগুলোতে অবৈধভাবে বাঁধ দিয়ে দখল করে রেখেছে প্রভাবশালীরা। এতে পানি নামতে পারছে না। জনগণ আমাদেরকে এ ব্যাপারে তথ্য দিয়ে সহযোগীতা করছে। প্রশাসনের উপস্থিতি ও জনগণের সহযোগীতায় অবৈধ বাঁধগুলো কেটে দেওয়া হচ্ছে।

Related News