ছোট ছেলেকে কবর দিয়ে মেঝো ছেলের ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে মা

, জাতীয়

রুহুল আমিন, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম | 2024-10-11 20:20:58

ডেঙ্গু নিয়ে দুই দিন আগে রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন সরকারি শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী ইয়ামীন। ভর্তির দিন রক্তে প্লাটিলেট ১ লাখ ৪০ হাজার থাকলেও গতকাল তা কমে ৫৫ হাজারে এসে ঠেকেছে। শরীরের ব্যথা ও অতিরিক্ত দুর্বলতায় কষ্ট হয় বিছানা থেকে উঠতেও।

গত মঙ্গলবার (৮ অক্টোবর) হাসপাতালে ভর্তি হলে সেদিনই হাতে লাগানো হয়েছিলো ক্যানোলা। তবে দুই দিন পর এসে ক্যানোলা আটকে রাখা ট্যাপের আঠা ছেড়ে দিচ্ছে, তাই হাতের নড়াচড়ায় ক্যানোলার এক পাশ বাঁকা হয়ে রক্ত বের হয়ে আসে সেখান থেকে। সেটা দেখিয়ে মাকে নার্স ডেকে আনার কথা বলছিলেন ইয়ামীন।

মা বসে ছিলেন ছেলের পায়ের পাশে। ছেলের কথা শুনে একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে দেখতে চাইলে নিষেধ করলেন ইয়ামীন, জানালেন ব্যথা হয়। তবে তারপরও মা ওঠছেন না। কেমন এক নির্লিপ্ততায় তাকিয়ে আছেন। পরে একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা বড় ভাই ইয়াছিন যান নার্সকে ডেকে আনতে।

কী হয়েছে জানতে চাইলে মা বার্তা২৪.কমকে জানান, ডেঙ্গু হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরেই জ্বর ছিল। চার দিন আগে ডেঙ্গু টেস্ট করালে পজিটিভ আসে। দুই দিন আগে জ্বরের মাত্রা বেশি হয়ে গেলে হাসপাতালে ভর্তি করান। ভর্তির প্রথম দিন প্লাটিলেট ১ লাখ ৪০ হাজার থাকলেও গতকাল তা শুধু ৫৫ হাজারে এসে ঠেকেছে।

আগে ভর্তি করাননি কেন জানতে চাইলে অশ্রুতে টলমল হয়ে ওঠে মায়ের চোখ। তিনি জানান, গত মঙ্গলবার তার ছোট সন্তান তাসকিন মারা যায় ডেঙ্গুতে। ডেঙ্গু পজিটিভ আসার পর বাসায় রেখেই চিকিৎসা দিচ্ছিলেন ছেলেকে। কিন্তু মঙ্গলবার হঠাৎ বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে নিয়ে যান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানকার কর্তব্যরত ডাক্তার হাসপাতালে পৌঁছাবার আগেই মারা যাবার কথা জানায়।

পরে দাফন করতে তাসকিনের লাশ নিয়ে যান গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। সেখানে কবর দেয়ার সব কাজ সম্পন্ন করে ঢাকায় ফিরতেই অসুস্থ হয়ে পড়েন মেঝো ছেলে ইয়ামীনও। ৩/৪ দিনের ব্যবধানে তিন সন্তানের মধ্যে এক সন্তানকে হারিয়ে ও মেঝো ছেলের এমন পরিস্থিতিতে শোকের অতল গহ্বরে এই মা।

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীরা, ছবি: বার্তা২৪.কম

ডেমরায় তিন ভাই ও বাবা-মাকে নিয়ে এক সাথে থাকতেন জানিয়ে বড় ছেলে ইয়াছিন বলেন, আমাদের বাসায় ঐভাবে মশা নেই কিন্তু তারপরও কিভাবে কী হয়ে গেলো কিছু বুঝলাম না। এক ভাইকে কবর দিয়ে আরেক ভাইকে নিয়ে আছি হাসপাতালে। গতকাল প্লাটিলেট কমে গেছে। আজ আবার টেস্টের জন্য রক্ত নিয়ে গেছে, রিপোর্ট দিলে বোঝা যাবে এখন কী অবস্থায় আছে।

শুধু ইয়ামীনই নয়, এমন আরও ৬১ জনকে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকার কথা জানা যায়। মুগদা হাসপাতালে একটি ওয়ার্ডে ৭০টি বেড ডেডিকেডেট করা হয়েছে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য। তবে ছুটির দিন হওয়ায় আজ রোগীর সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম।

এসময় কথা হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে আসা আরেক ডেঙ্গু রোগী আরিফুল হাসানের সঙ্গে। এক সপ্তাহ ধরে জ্বর। চারদিন আগে টেস্ট করাতে এসে ডেঙ্গু জানতে পারেন তিনি। সেই থেকে হাসপাতালেই আছেন। আরিফুল বার্তা২৪.কমকে জানান, ডেঙ্গুতে অবস্থা খারাপ; জ্বর, ঠান্ডা, মাথাব্যথা, পুরো শরীর থেকে পায়ের তলা পর্যন্ত ব্যথা। এখন কিছুটা ভাল। তবে আরও কতদিন থাকা লাগবে বলতে পারি না।

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে হাসপাতালে ভর্তি আছেন মিনহাজ। তেজগাঁওয়ের একটি মাদ্রাসা থেকে এবার আলিম (এইচএসসি সমমান) পরীক্ষা দিয়েছেন। আজ জ্বর নেই, প্লাটিলেটও বাড়ছে জানিয়ে মিনহাজ বার্তা২৪.কমকে বলেন, হাসপাতালে যখন ভর্তি হই তখন প্লাটিলেট ছিল প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার। পরে কমতে কমতে ৪৪ হাজারে নেমে আসে। গত দুই দিন ধরে বেড়ে গতকাল ছিল ৯০ হাজার।

ডেঙ্গু হলো কিভাবে জানতে চাইলে মিনহাজ আরও বলেন, আমি যে মেসে থাকি সেখানে মশা ঐরকম বেশি না। তবে একটা কাজে কাওরান বাজার গেছিলাম ৩ অক্টোবর। কাওরান বাজার থেকে আসার পরেই শুরু হয় জ্বর। প্রথমে জ্বর বেশি না থাকলেও পরে ১০৩/১০৪ তে ওঠে যায়।

এনিয়ে হাসপাতালের ডেডিকেটেড ডেঙ্গু ওয়ার্ডের এক কর্তব্যরত নার্স নাম প্রকাশ না করে জানান, আজকে রোগীর সংখ্যা কিছুটা কম। আমাদের এখানে ৭০টা বেড থাকলেও ৬২ জন ভর্তি আছেন। এর মধ্যে আরও কিছু ছুটি নিয়ে চলে যাবেন। এখানে এখন পর্যন্ত একদিনে ১১৫-১২০ জন পর্যন্ত রোগী ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। তবে এখন আর ৭০ জনের বেশি ভর্তি নিচ্ছি না। এর বেশি আসলে অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দিচ্ছি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্যমতে, চলতি বছরের ১০ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪০ হাজার ৪০৫ জন যেখানে মারা গেছেন ১৯৯ জন। আর চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ৯ হাজার ৪৬৭ জন ডেঙ্গু নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। মারা গেছেন ৩৬ জন ডেঙ্গু রোগী।

Related News