ফেনীর ভয়াবহ বন্যার দুই মাস, অনভিজ্ঞতায় ব্যাপক ক্ষতি

, জাতীয়

মোস্তাফিজ মুরাদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ফেনী | 2024-10-17 15:16:29

ফেনীর উত্তরাঞ্চলের দুই জেলা ফুলগাজী ও পরশুরামের মানুষের মুহুরী নদীর বাঁধ ভাঙার ফলে বন্যার বিষয়ে কিছুটা অভ্যস্ত থাকলেও বন্যার বিষয়ে একেবারেই অভিজ্ঞতা ছিল না ফেনীর দক্ষিণ পূর্বাঞ্চলের উপজেলা ছাগলনাইয়া ও ফেনী সদর, দাগনভুঞা ও সোনাগাজী এলাকার সাধারণ মানুষের। ফলে বন্যার আগাম প্রস্তুতি কিংবা বন্যা পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে ধারণা না থাকায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় সাধারণ মানুষ। বন্যায় করণীয় সম্পর্কে পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বেড়েছে বলে মনে করছেন সাধারণ মানুষ।

জানা গেছে, প্রতিবছর ১৩ অক্টোবর দুর্যোগ প্রশমন দিবস পালন করা হয়। প্রতিবার দিবসটি উপলক্ষে ঘূর্ণিঝড় কিংবা আগুন লাগলে করণীয় সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কিংবা আলোচনা হলেও বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের আগে কিংবা পরবর্তীতে করণীয় সম্পর্কে তেমন ধারণা দেয়া হয় না। ফলে ফেনীর বেশিরভাগ মানুষই এ দুর্যোগের বিষয়ে অনভিজ্ঞ। আগামী থেকে বন্যার বিষয়ে দুর্যোগ প্রশমন দিবসে জোর দেয়া এবং স্থানীয়দের এসব বিষয়ে প্রস্তুত করে তোলার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের।

চলতি বছরের আগস্টের শেষ দিকে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে ফেনী। আগস্ট মাসের শেষ ১০ দিন বন্যার প্রকোপে ফেনীর কৃষি, ঘরবাড়িসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি এখনো জনপদে স্পষ্ট। এখন চলছে পুনর্বাসনের কাজ। প্রবল বৃষ্টি এবং ভারত হতে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে ১৯ আগস্ট রাতে ডুবতে শুরু করে ফেনীর উত্তরাঞ্চল। এরপর ১০দিনে সম্পূর্ণ ফেনী জেলা বন্যায় নিমজ্জিত হয়।


স্থানীয়রা জানান, ফেনীর মানুষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলতে বোঝে শুধুমাত্র ঘূর্ণিঝড়। বন্যা, খরা, আইলার মতো এসব দুর্যোগের বিষয়ে তেমন কিছু জানেনা এ জেলার মানুষ। যার ফলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও বেশি হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।

ছাগলনাইয়ার নিজকুঞ্জরা এলাকার কাশেম চৌধুরী নামে বয়োবৃদ্ধ একজন জানান, আমার ৭৫ বছর বয়সে এমন বন্যা আমি দেখিনি। এলাকার মধ্যে আমাদের বাড়ি সব থেকে উঁচু তবে এখানেও পানি উঠেছে। এ এলাকার মানুষ বন্যার সঙ্গে অভ্যস্ত না। যখন পানি বাড়ছিল তখনও সবাই মনে করেছে রাতের মধ্যে নেমে যাবে। বন্যার পানি এ এলাকায় প্রবেশ যখন করছিল তবুও কেউ এলাকা ছেড়ে যায়নি, হঠাৎ সব পানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ফলে আসবাপত্রসহ, ফ্রিজ, টিভি সব পানিতে ডুবে ক্ষয়ক্ষতি হয়।

ঘোপাল ইউনিয়নের লাঙ্গলমোড়া গ্রামের বাসিন্দা মাঈন উদ্দিন জানান, বন্যায় দোকান-ঘরবাড়িসহ তার প্রায় ৫ লাখ টাকা ক্ষতি হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের বাড়ির সামনে ফেনী নদী। নদীর পানি বাড়লে জোয়ারে কিছু পানি লোকালয়ে প্রবেশ করতে পারে এটা আমাদের কাছে স্বাভাবিক বিষয় ছিল।।কিন্তু এভাবে পানির তীব্র স্রোতে ঘর ভাসিয়ে নেবে সেটি এলাকার কেউ ধারণা করতে পারেনি। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষের প্রস্তুতি থাকে। আমি তো দূরের কথা আমার বাবারাও এমন বন্যা দেখেনি। আমরা জানিওনা কিভাবে কি করতে হবে কোথায় যেতে হবে। যার কারণে আমাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ফেনী সদরের ফাজিলপুর এলাকার এমদাদুল হক নামে একজন বলেন, আমার নিজের চোখে পানির এমন ভয়াবহতা কখনও দেখিনি। ফেনী নদীর পানি বাড়লেও কখনও ফাজিলপুরে পানি ওঠেনি, যার কারণে আমরা ওভাবে চিন্তিতও ছিলাম না। কিন্তু সকালে বৃষ্টি হলে সন্ধ্যায় ঘরের সামনে গলা সমান পানি। না পেরেছি আসবাবপত্র সরাতে না পেরেছি ঘরের ধান-চাল সরাতে। সব পানিতে ডুবে শেষ হয়ে গেছে। আমরা জানিওনা বন্যা হলে কি করতে হয়, নিজেরা আটকে ছিলাম ঘরে। পরে উদ্ধারকর্মীরা এসে উদ্ধার করে নিয়ে যায়।

একই কথা বলছেন দাগনভুঞার আব্দুল্লাহ আল মামুন। তিনি জানান, ঘরবাড়ি ছেড়ে পরিবারের সবাইকে নিয়ে দ্রুত আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়েছি।তবে ঘরের কিছু সরিয়ে আনতে পারিনি। পরনের জামা কাপড় নিয়ে বের হয়ে গেছি। ৩ দিন পর বাড়িতে গিয়ে দেখি ঘরের ফ্রীজ ভাসতেছে।পাশাপাশি আলমিরাতে থাকা কাপড়চোপড়, আসবাপত্র, টিভি সব নষ্ট হয়ে গেছে।

সোনাগাজীর বাসিন্দা নুরুল হক বলেন, সোনাগাজীর মানুষ ঘূর্ণিঝড় সম্পর্কে জানে।তখন আমাদের আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বলা হয়, এবারের বন্যায় ছিলনা কোন সতর্কতা। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল পুরো জেলা। কি থেকে কি হয়েছে নিজেরাই বুঝে উঠতে পারিনি। এসব বিষয়ে আমাদের সতর্কতা বাড়ানো উচিত। ঘূর্ণিঝড়ের করণীয় যেভাবে জানানো হয় বন্যার করণীয় সম্পর্কেও জানানো উচিত।

অন্যদিকে ফুলগাজী পরশুরামে ক্ষয়ক্ষতি হলেও সেখানকার মানুষ বলছেন তারা বন্যার পানিতে অভ্যস্ত। তবে এবারের বন্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। ফুলগাজীর দরবারপুরের বাসিন্দা মোবারক হোসেন। বন্যায় তার বসতভিটা ও বিলীন হয়ে গিয়েছিল। তিনি জানান, মুহুরী নদীর বাঁধ প্রতিনিয়তই ভাঙে। এবারের বন্যার আগেও ভেঙেছে তবে এমন দশা হতে পারে কেউ কল্পনাও করেনি। বন্যা পূর্ববর্তী অবস্থা দেখে ঘরবাড়ি থেকে জানে বেঁচে অন্যর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, ঘরের কিছু জিনিস নিতে পারলেও জানের ভয়ে সব বের করতে পারিনি। তবে এ সময়ে কি করতে হয় আমরা জানি, তবে এবারের অভিজ্ঞতা একেবারেই ভিন্ন।

ফুলগাজী পরশুরামের একাধিক বাসিন্দা জানান, বাঁধ ভেঙে যাওয়ার ফলে তারা এক বছরে ৩ বার ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়েছে। তবে ২৪ আগস্টের বন্যা সব রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আগামীতে এমন ভয়াবহতা রোধে অগ্রিম পূর্বাভাস ও টেকসই বাঁধ নির্মাণের দাবি জানান তারা।


জেলা প্রশাসন হতে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা গেছে, জেলায় ৮ হাজার ৯৫টি কাঁচাঘর, ২৫০টি আধাপাকা ঘর বন্যায় সম্পূর্ণ ধসে গিয়ে আনুমানিক ক্ষতি হয়েছে ১৬৩ কোটি ১১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। ৫৩ হাজার ৪৩৩টি কাঁচাঘর এবং ২ হাজার ৬৩২টি আধাপাকা ঘরের আংশিক ক্ষতির আর্থিক পরিমাণ ৩৭০ কোটি ৭৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৬৪ হাজার ৪১৫টি ঘরবাড়িতে মোট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ৫৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ৭০ হাজার টাকা। এছাড়া ৫৪টি মসজিদ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে মোট ৬ কোটি ৯১ লাখ ৬০ হাজার ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয়েছে। এছাড়া ১৪৪টি মন্দিরে ৪৫ লাখ ২০ হাজার টাকা ক্ষয়ক্ষতি নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও কৃষিখাত, প্রাণিসম্পদ, বিদুৎ ও সড়কে বিশাল অংকের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

অন্যদিকে বন্যায় বিপর্যস্ত হওয়া সাধারণ মানুষ বলছেন বন্যার কোনো পূর্বাভাসই জানতেন না তারা। বিশেষ করে ছাগলনাইয়া, ফেনী সদর, দাগনভুঞা ও সোনাগাজীর মানুষ তাদের এলাকায় বন্যা হতে পারে এমন চিন্তাও করেননি। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য উঠে এসেছে।। তারা বলছেন, পূর্বাভাস ফেলে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।

ছাগলনাইয়ার একরাম উদ্দিন বলেন, যেখানে আমাদের দাদারা এমন বন্যা দেখেনি আমাদের দেখার ত প্রশ্নই আসেনা। বন্যার কথা শুনে ভেবেছি ফুলগাজী পরশুরামে হয়েছে। আমাদের এদিকে আসার ত সম্ভাবনা নেই। যার কারণে আমাদের কোন প্রস্তুতিও ছিলনা। অগ্রিম পূর্বাভাস ফেলে হয়ত বিহৎ আকারের ক্ষয়ক্ষতি কিছুটা হলেও কম হতো।

তিনি বলেন, সরকারি যে প্রতিষ্ঠান গুলো আবহাওয়ার তথ্য দেয় তারা অনেক সময় ভুল তথ্য দেয়। দেখা যায়, ঘূর্ণিঝড়ের ১০ নম্বর বিপদ সংকেত কিন্তু বৃষ্টিও হয়না। বন্যা নিয়ে আরও গবেষণা প্রয়োজন। স্থায়ী সামাধান ও উদ্যোগের মাধ্যমে বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিস্থিতি মানুষকে অবগত করা প্রয়োজন তবেই ভবিষ্যতে মানুষ সতর্ক থাকতে হবে।

সদর উপজেলার রহিম উল্ল্যাহ বলেন, এবারের বন্যা থেকে অনেক কিছু শেখার আছে। আমাদের যদি পূর্ব প্রস্তুতি থাকত এত ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হতাম না। সরকারিভাবে এটির উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন যাতে আগামীতে বন্যার পূর্বাভাস আগে থেকে দেয়া যায়। না হয় এবারে যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেটা আবার হলে ফেনীর মানুষ আর ঘুরে দাঁড়াতে পারবেনা। এসময় তিনি এমন পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ কিংবা সচেতনতামূলক কার্যক্রম আয়োজনের দাবি জানান।

Related News