আ’লীগকে ‘ম্যানেজ করে’ বন্দরে সাইফ পাওয়ারটেকের ‘সাম্রাজ্য’

, জাতীয়

স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো | 2024-10-19 11:23:58

গল্পটা যেন সুচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বেরোনোর মতো। সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড শুরুতে চট্টগ্রাম বন্দরে ঢুকেছিল কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে। সেই প্রতিষ্ঠানটিই দেড়যুগের ব্যবধানে এখন বন্দরের সবচেয়ে ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠান। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠানটি একে একে বাগিয়ে নেন সিসিটি এবং এনসিটির টার্মিনাল পরিচালনার কাজ। সাইফ পাওয়ারটেকের এমন উচ্চলাফ দেখে অনেকেই তাদের বলছেন-বন্দরের সুপার পাওয়ার।

আওয়ামী লীগের নেতাদের ‘ম্যানেজ করে’ ব্যবসার বিস্তার ঘটানো সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড নামের এই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার তরফদার রুহুল আমিন। দেশের তিন সামুদ্রিক বন্দরেই একচ্ছত্র আধিপত্য তার। রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার দাপটে এত বছর ধরে কেউ সাইফ পাওয়ারটেক নিয়ে মুখ না খুললেও ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে কথা বলেছেন অনেকে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম শাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি বন্দরে পরিদর্শনে এসে সংস্থাটির নানা অনিয়ম নিয়ে কথা বলেছেন। এরপর সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে হয়েছে মানবন্ধন, সক্রিয় হয়েছে প্রশাসনও।

বন্দর সূত্র জানায়, আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তি আছে। এরপর তাদের সঙ্গে আর চুক্তি না করার দাবি এসেছে শ্রমিক সমাবেশ থেকে। একইসঙ্গে সিবিএ নেতাদের একটা অংশকে ব্যবহার করে বন্দরের পরিস্থিতি অস্থির করে তোলার অভিযোগ তুলে সাইফ পাওয়ারটেককে চট্টগ্রাম বন্দরে কালো তালিকাভুক্ত করার দাবিও জানিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।

সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ:

২০০৬ সালের আগে জাপানের সুমিতমো করপোরেশনের কাছ থেকে চারটি রেল মাউটেন্ট কি গ্যান্ট্রি ক্রেন সংগ্রহ করেছিল বন্দর কর্তৃপক্ষ। মাউটেন্ট কি গ্যান্ট্রি ক্রেন পরিচালনা এবং রক্ষণাবেক্ষণের স্থানীয় এজেন্ট ছিল সাইফ পাওয়ারটেক। এর মধ্যেই বন্দরে সাইফ পাওয়ার টেক-যুগের শুরূ। ওই সময়ে প্রভাব কাজে লাগিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে ১২টি শর্ত পরিবর্তন করিয়ে আইনি বাধা অতিক্রম করার অভিযোগ ওঠেছিল প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। সিসিটি পরিচালনায় বন্দরের যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সাইফ পাওয়ারটেককে বিশেষ সুবিধা দিতে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজেদের আইন পরিবর্তন করেছিল বলে তখন আলোচনা হয়েছিল!

সাইফ পাওয়ারটেকের দাপটের এখানেই শেষ নয়। ২০০৬ সালে বন্দরের মাত্র ১৫০ টাকা হারে টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের কাজের জন্য দরপত্র জমা দেয় ‘এভারেস্ট পোর্ট সার্ভিস লিমিটেড’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। সর্বনিম্ন দরদাতা এই প্রতিষ্ঠান কার্যাদেশ না পেলেও উচ্চমূল্যে কাজটি কিনা বাগিয়ে নেয় সাইফ পাওয়ারটেক। এখন প্রতি টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ের জন্য চার্জ নেওয়া হচ্ছে ৯০০ টাকা হারে। সাইফ পাওয়ারটেকের হিসাব অনুযায়ী, ২০০৭ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানটি কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করেছে ২ কোটি ১০ হাজার ৭৩৯ টিইইউএস। কয়েক বছর আগে এই হার ছিল ১ হাজার ২০০ টাকা। ব্যবসায়ীদের আপত্তির মুখে চার্জ কমাতে বাধ্য হয়েছিল প্রতিষ্ঠান। বর্তমান চার্জ অনুযায়ী ১৭ বছরে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং বাবদ সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে প্রতি টিইইউএস কন্টেইনার হ্যান্ডলিংয়ে বাড়তি নেওয়া হয়েছে ৭৫০ টাকা হারে। সেই হিসাবে শুধু কন্টেইনার হ্যান্ডলিং থেকেই প্রতিষ্ঠানটি বাড়তি আয় করেছে দেড় হাজার কোটি টাকার বেশি।

সাইফ পাওয়ারটেক ২০১৫ সালে বাগিয়ে নেয় এনসিটি টার্মিনালের চারটি জেটির কাজ। এই কাজ পাওয়ার পরই বন্দরে প্রতিষ্ঠানটির একক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। ডিপিএম (ডাইরেক্ট প্রকিউরমেন্ট মেথড) পদ্ধতিতে প্রতি বছর অন্তত ৭০ শতাংশ কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করছে প্রতিষ্ঠানটি। শুরুটা যন্ত্রপাতি মেরামতকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে হলেও পরবর্তীকালে একের পর এক কাজ বাগিয়ে নেয় প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগের তিনজন সাবেক সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতাকে কাজের ভাগ দিয়েই বন্দরে এই রাজত্ব কায়েম করেছিল সাইফ পাওয়ারটেক।

আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী, বন্দরে টার্মিনাল অপারেটররা নিজেদের যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা করে কন্টেইনার হ্যান্ডলিং করার কথা। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরে সেই নিয়ম নেই। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বন্দরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সাইফ পাওয়ারটেক। দেশের অন্য বন্দরগুলোতেও রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের প্রভাব।

বন্দরের মতো স্পর্শকাতর জায়গায় অবৈধ ও নিববন্ধনহীন গাড়ি ব্যবহার করেও আসছিল সাইফ পাওয়ারটেক। সম্প্রতি এক অভিযানে তাদের এমন ৬০টি গাড়ির সন্ধান পায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ। পরে এই অভিযোগে ১০টি তাদের ট্রেইলার গাড়িকে ৩ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বন্দরে সাইফ পাওয়ার টেকের কতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন রুহুল আমিন তরফদার পতিত আওয়ামী লীগের কেউ-ই ছিলেন না সেটি প্রমাণের চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। তবে ব্যবসায়ী আর শ্রমিকনেতারা বলছেন, রঙ বদলিয়ে একদিকে সাইফ পাওয়ারটেক একদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সুদৃষ্টিতে থাকতে অন্যদিকে ভবিষ্যৎ সরকারের সুনজরে থাকার প্রচেষ্টাও অব্যাহত রেখেছে।

চুক্তি বাতিলের দাবি শ্রমিক নেতাদের:

গত সপ্তাহে চট্টগ্রাম বন্দর ভবনের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ মিছিল ও সমাবেশ করেছিল জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল। সেখানে সাইফ পাওয়ারটেকের সঙ্গে চুক্তিবাতিলসহ বন্দরের এক ইঞ্চি জায়গাও বিদেশি কিংবা বেসরকারি কোম্পানির কাছে যেতে দেবে না বলে হুঁশিয়ার করেন শ্রমিক নেতারা।

জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের (সাবেক সিবিএ) ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মো. হুমায়ুন কবীর বলেন, ‘আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেকের চুক্তি আছে। এরপর তাদের সঙ্গে আর চুক্তি করা যাবে না। একইসঙ্গে সাইফ পাওয়ারটেককে চট্টগ্রাম বন্দরে কালো তালিকাভুক্ত করতে হবে। তারা সিবিএর এক নেতার মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দরকে অস্থিতিশীল করতে চায়। তাদের এ আশা বাস্তবায়ন করতে দেব না আমরা।’

সক্রিয় প্রশাসন:

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম শাখাওয়াত হোসেন সম্প্রতি বন্দর পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে গত ৮ অক্টোবর বন্দরের এনসিটি-৩ জেটিতে বন্দর সফর নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তখন তিনি বলেন, ‘এখানে (চট্টগ্রাম বন্দরে) অনেক অনিয়ম হয়েছে। সেটা বলতে গেলে সারাদিন লাগবে। অনেককে লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। তারা কারও চাচা, ভাই বা মামা। এ সবই কিন্তু আমাদের নজরে আছে। অন্যায়ভাবে অনেক কাজ এখানে হচ্ছে। এ বন্দরকে আমাদের জঞ্জাল মুক্ত করতে হবে।’

অনিয়ম নিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় এবং পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার এই শক্ত অবস্থানের পরপরই সেখানে অভিযানে যায় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও বিআরটিএ। তাদের অভিযানে ধরা পড়ে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে সাইফ পাওয়ারটেকের রেজিস্ট্রেশনবিহীন গাড়ির অবাধ চলাচল। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এসব গাড়িতে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।

অভিযানে অংশ নেওয়া একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সাইফ পাওয়ারটেকের ৬০টি নিবন্ধনহীন ভারী গাড়ি বন্দরের অভ্যন্তরে চলাচলের সময় ধরা পড়ে। এই ধরণের এক একটি গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করলে সরকার কমপক্ষে দুই লাখ টাকার মতো সরকার রাজস্ব পেতো। এছাড়া প্রতিবছর ফিটনেস এবং ট্যাঙ টোকেন ও ইনকাম ট্যাঙ বাবদ প্রতি গাড়ি থেকে কমপক্ষে ৭০ হাজার টাকা সরকারের রাজস্ব আয় হতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠজন হওয়ায় সাইফ পাওয়ারটেকের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার কেউ সাহস করেননি। সেই কারণে রেজিস্ট্রেশন না করিয়ে বছরের পর বছর ধরে এসব গাড়ি চললেও এক টাকাও রাজস্ব পায়নি সরকার।’

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে সাইফ পাওয়ারটেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তরফদার মো. রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের নির্বাচনকে ঘিরে তরফদার মো. রুহুল আমিন বেশকিছুদিন ধরে ঢাকায় ব্যস্ত রয়েছেন।

Related News