দুই দশক আগের কথা বর্ষায় ‘নাও’ আর শুকনায় ‘পাও’ এই প্রবাদ প্রচলন ছিল কিশোরগঞ্জ হাওরে। সময়ের বিবর্তনে কিছু পরিবর্তন হলেও এর সিংহভাগই রয়ে গেছে। ফলে হাওরের মানুষের কাছে প্রবাদ বাক্যটির বাস্তবতা রয়ে গেছে। বিশেষ করে শিক্ষাক্ষেত্রে। তবে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য হাওরের বিশাল জলরাশির মাঝে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি ভাসমান পাঠশালা।
তেমনি কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকার নিকলী উপজেলায় রয়েছে কয়েকটি ভাসমান পাঠশালা। এসব স্কুলে লেখাপড়ার পাশাপাশি বিনামূল্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা ও বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে।
হাওর এলাকার জনপদের মানুষ সবসময় অবহেলিত। বিশেষ করে শিক্ষা ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া এক বিশাল জনগোষ্ঠীর বসবাস নিকলী উপজেলার ঘোড়াউত্রা নদীপারের দুটি ইউনিয়ন ছাতিরচর ও সিংপুরের। এ দুই ইউনিয়নের অধিকাংশের পেশা কৃষি ও মৎস্যজীবী। চরম দারিদ্র সীমার নিচে বসবাস করা এই মানুষগুলোকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা পপি চালু করেছে ভাসমান স্কুল। অভিভাবক ও এলাকাবাসীর কাছে এসব স্কুল এখন জলে ভাসা স্কুল হিসেবেই পরিচিতি লাভ করেছে।
২০০৯ সাল থেকে সংস্থাটি কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ভাঙন কবলিত ছাতিরচর ও নিকলী ইউনিয়নে স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় ৭টি ভাসমান প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচলনা করে আসছে।
ঘোড়াউত্রা নদীর তীরে ভাসমান এসব বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছে ৩৩০ জন শিক্ষার্থী। স্কুল থেকে বিনামূল্যে মিলছে বই, খাতা, কলমসহ শিক্ষা উপকরণ। নৌকার ভেতর শিক্ষকরা পরম মমতায় শিশুদের পাঠদান করাচ্ছেন। খেয়াল রাখছেন তাদের মানসিক বিকাশের দিকেও। সমাজের অবহেলিত শিশুরা এসব স্কুলে লেখাপড়া করলেও তাদের সচেতন করা হচ্ছে সামাজিক, রাজনৈতিকসহ সমসাময়িক বিষয়ে।
শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া শিশুরা ৬ বছর লেখাপড়া শেষ করে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষা পাস করার পর নিজেদের উদ্যোগে নিকটতম উচ্চ বিদ্যালয়ে তাদের ভর্তির ব্যবস্থা করা হয়। এখানে লেখাপড়া করে সুফল পেয়েছে হাওড়াঞ্চলের হতদরিদ্র শিশুরা। অনেকেই এখন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
সকাল আটটা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত চলে এসব ভাসমান স্কুলের ক্লাস। লেখাপড়ার পাশাপাশি শিশুদের মেধা বিকাশে প্রতিটি স্কুলে লাইব্রেরি ও শিক্ষণীয় ফটো গ্যালারির পাশাপাশি রয়েছে শিশুতোষ খেলাধুলার নানাবিধ আয়োজন। শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের এমন উন্নত ও জীবনবান্ধব পদ্ধতি ব্যবহার করে চলে শিক্ষাগ্রহণে গভীর মনোযোগী করে তোলার প্রয়াস। ফলে লেখাপড়া শেখার আগ্রহে ভাটা পড়েনি কখনও।
বর্তমানে এ সাতটি ভাসমান স্কুলে ৩৩০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। ইতোমধ্যে এসব ভাসমান স্কুল থেকে সাফল্যের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করেছে হাজারের অধিক শিক্ষার্থী। এদের অনেকেই এখন দেশের বিভিন্ন মাধ্যমিক স্কুল, কলেজ ও ইউনিভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে।
প্রকল্প সমন্বয়কারী জহিরুল ইসলাম বলেন, হাওরের শিক্ষার মান উন্নত করতে আমরা ভাসমান পাঠশালার আয়োজন করেছি। শিশুদের কাছে এটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছে।
পপি নির্বাহী পরিচালক মুর্শেদ আলম সরকার বলেন, শিশুদের লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছি। ভাসমান নৌকায় লেখাপড়ার বিষয়টি শিশুদের মনে আনন্দ দেয়।