চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় করণীয় 

  • আবু আহমেদ
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবন বিপর্যস্ত। ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন অজুহাতে নিত্যপণ্যের দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিপাকে ফেলছে। একবার যে পণ্যের দাম বাড়ে, তা সহজে আর কমে না। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বর্তমানে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে গেছে। নিঃসন্দেহে দরিদ্র মানুষ স্বল্প আয়ে চলতে পারছে না। বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি এসব দরিদ্র লোকের জন্য কিছু ব্যবস্থা করতে হবে। তাদের সরকারি সহায়তা দিতে হবে।

টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি আরও বাড়াতে হবে। তবে এ সংকট শিগগিরই দূরীভূত হওয়ার নয় বলে মনে হচ্ছে। বাংলাদেশে ডলার সংকটের প্রভাবে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, সুদের হার, পণ্য আমদানি-রপ্তানি, রাজস্বসহ কোনো সূচকেই সন্তোষজনক অবস্থান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। যে কারণে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমেই দুর্বল হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে। এ ছাড়া মুদ্রাবাজারেও চরম অস্থিরতা বিদ্যমান। খোলাবাজারে ক্রমবর্ধমান ডলারের দাম, একই সঙ্গে অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রারও সংকট তৈরি হয়েছে। নানা কারণেই দেশের সামষ্টিক অর্থনীতি বহুবিধ চ্যালেঞ্জের মুখে।

বিজ্ঞাপন

এ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক নানা কর্মকৌশল অবলম্বন করেছে। তবে এত দ্রুত কাঙ্ক্ষিত ফল পাওয়া কঠিন। ব্যাংকিং খাতে সুদের হার বৃদ্ধির সঙ্গে শেয়ারবাজারের সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে শেয়ারবাজার নিম্নমুখী এবং বেচাকেনা ঠিকমতো হচ্ছে না। বিভিন্ন দেশের শেয়ারবাজারের অবস্থা তুলনামূলকভাবে ভালো, মূল্যস্ফীতিও অনেকটা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থা অপেক্ষাকৃত নাজুক। দেশের শেয়ারবাজার তার মূল্যমান হারিয়েছে। মূল্যস্ফীতি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতির অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। আগামী দিনগুলোয় যে এটি খুব ভালো হবে, সহসা সেটিও আশা করা যায় না। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এক ধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে।

নিরীহ মানুষের প্রাণহানিসহ মূল্যবান সম্পদ বিনষ্ট হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানি, ব্যবসাবাণিজ্য ও সাধারণ মানুষের জীবনপ্রবাহ। রেমিট্যান্সপ্রবাহ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও লক্ষ্যপূরণের নিশ্চয়তা এখনো পাওয়া যায়নি। তারল্যসংকটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ধার নিয়ে চলছে দেশের অধিকাংশ ব্যাংক। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই ধার করা হয়েছে সর্বোচ্চ অঙ্কের টাকা, যা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার ক্ষেত্রে একটি রেকর্ড। ব্যাংকে খেলাপি ঋণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কায়দায় দেশ থেকে প্রচুর অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

দেশের প্রতি আস্থাহীনতা ও নিরাপত্তাজনিত দুশ্চিন্তা থেকেই মানুষ বিদেশে এসব অর্থ পাচার করেছে। ধনীরা সন্তানসন্ততিদের নিরাপত্তার কথা ভেবে বিদেশে টাকা পাচার করেছে। বিভিন্ন পদে আসীন থাকা অবস্থায় কর্তাব্যক্তিরা নানারকম অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এরা দেশ থেকে প্রচুর অর্থ লুট করে বাইরে পাচার করেছে। এভাবেই শেয়ারবাজারের বড় একটি মূলধন হাতছাড়া হয়। ব্যবসায়ী নামধারী দুষ্কৃতকারীরা অতীতের মতোই শেয়ারবাজার থেকে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়েছে। ব্যাংকে দীর্ঘ সময়ের জন্য যারা লেনদেন করেন, তার পরিমাণও কমেছে। প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কঠোর ভূমিকা পালন করতে হবে।

দেশের অর্থনীতিকে মোটামুটি সচল রাখা পোশাকশিল্পেও নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে দেখা গেছে। কতিপয় সুযোগসন্ধানী অনাকাঙ্ক্ষিত কর্মকাণ্ড চালানোর চেষ্টা করেছে। একের পর এক পণ্য আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত হয়েছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতায় একসঙ্গে যতগুলো সংকট এসেছে, তা অতীতে কখনো মোকাবিলা করতে হয়নি। তারই নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আমাদের ওপর। বাইরে থেকে এ ধরনের সংকট এলে আমরা ঠেকাতে পারব না। এসব করে অর্থনৈতিক সংকটকে আরও গভীর করা হয়েছে। কাজেই দেশের স্বার্থে, শিল্পের স্বার্থে সংকটগুলো সমাধানে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।

কিছু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ব্যাংক বা অন্য কোনো খাতে যেন কাঠামোগত সংকট দেখা না দেয় এবং বৈদেশিক দায়দেনা পরিশোধের ক্ষেত্রেও যেন কোনো সমস্যা তৈরি না হয়। বর্তমানে রীতিমতো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে অধিকাংশ ব্যাংককে চলতে হচ্ছে। কিছু ব্যাংক অনেক আগেই তাদের পুরোপুরি সক্ষমতা হারিয়েছে। অনেক ব্যাংককে অন্যদের সঙ্গে একীভূত কিংবা গুটিয়ে ফেলতে হচ্ছে। অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। এ ছাড়া সরকার আইএমএফ ও অন্য দাতাদের কাছ থেকে যেসব সংস্কারের শর্তে ঋণ নিচ্ছে, সেগুলো বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না পারলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ানো নিয়ে শঙ্কা তৈরি হতে পারে বলে প্রতীয়মান হয়। দেশে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাবে। মূল্যস্ফীতি আরও বাড়তে থাকবে। টাকা তার মূল্যমান হারাতে থাকবে। যদি রিজার্ভ বৃদ্ধি না পায়, সে ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যা বাড়বে।

রিজার্ভ বৃদ্ধির কোনো কারণ দৃশ্যমান হয় না। রপ্তানি আয় খুব একটা বাড়ছে না। অন্যদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগও অনেক কমেছে। বৈদেশিক মুদ্রা যেভাবে দেশে আসত, সেগুলোও স্থবির হয়ে গেছে। এটি আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়। আমাদের আমদানি করার সক্ষমতা কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশ আগের ঋণ শোধ করার জন্য নতুন ঋণ গ্রহণ করছে। সেটিও আগের ঋণ শোধ করতেই চলে যাবে। সরকারের ঋণ অনেক বেড়ে গেছে। সরকারকে বুঝেশুনে প্রকল্প নেওয়ার বিষয়ে চিন্তা করা দরকার।

বড় ধরনের কোনো সংস্কার ছাড়া অর্থনীতির সংকট মোকাবিলা কঠিন হবে। কাজেই অর্থনীতির চাকাকে সচল করতে হলে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি কেমন হবে, তার ওপর অর্থনীতির সংকট উত্তরণ নির্ভর করবে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন। সংকট দূর করে উন্নয়নের পথে দেশকে এগিয়ে নিতে অনুকূল পরিবেশের বিকল্প নেই।

রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা ও সহিষ্ণুতা না থাকলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই হয় না। যেকোনো সমস্যা সমাধানে যৌক্তিক আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতা দল-মতনির্বিশেষে প্রত্যেক নাগরিককে নিজের অবস্থান থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে জনসচেতনতার পাশাপাশি জনমত গঠন জরুরি। সব অপতৎপরতা বাদ দিয়ে জনপ্রতিনিধিদের দেশ গঠনে মনোযোগ দিতে হবে। নানা ধরনের প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে সচল রাখতে হলে অবশ্যই সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও সুশাসন দরকার।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও চেয়ারম্যান, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)

খবরের কাগজ’র সৌজন্যে