অন্তবর্তী সরকারকে পণ্যের উৎপাদন, সরবরাহ, আমদানি এবং বাজার স্থিতিশীল রাখাসহ প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের বেতন-ভাতা পরিশোধে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিকে প্রয়োজনীয় তহবিল ব্যবহারের সুযোগ দেওয়া উচিত বলে মনে করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আব্দুল বায়েস।
মাল্টিমিডিয়া নিউজপোর্টাল বার্ত২৪.কম-কে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের অনেক শিল্প-প্রতিষ্ঠানসমূহে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট সামষ্টিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে মনে করেন অধ্যাপক বায়েস।
দেশের অর্থনীতির সমসাময়িক বিষয় নিয়ে আলাপচারিতায় জ্যেষ্ঠ এই অর্থনীতিবিদ কথা বলেছেন-দেশের ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে শিল্প উৎপাদন ও বৈদেশিক বিনিয়োগসহ নানা প্রসঙ্গে।
বার্তা২৪.কম: বড় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলির হাতেই এখনও দেশের আমদানি সেক্টরের সিংহভাগ নির্ভরশীল। বাজার স্থিতিশীলে বৃহৎ আমদানিকারকদের নিয়ে সরকারের কি পদক্ষেপ থাকা উচিত? তাদের কোন বিকল্প কি আছে?
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস: তাদের বিকল্প এখনও নাই। সরকারের নীতি হওয়া উচিত ‘বিজনেস শুড নট বি পানিশড, বিজনেসম্যান শুড বি পানিশড’। কেউ যদি অন্যায় করেন, ভুল করেন তাকে শাস্তি দিন কিন্তু তার ফ্যাক্টরি বা প্রডাকশন কেন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে...। যেমন ধরুন ‘এস আলম’। প্রতিষ্ঠানটি অনেক জরুরি নিত্যপণ্যের বৃহৎ আমদানিকারক। তাদের যেসব প্রতিষ্ঠান এসব সেবায় নিয়োজিত, বহু কর্মীর বেতন দেয়-এগুলোর একাউন্ট ফ্রিজ করা উচিত নয়। তাদের চলতে দেওয়া উচিত। হ্যা, মনিটর করা উচিত ওই ব্যবসায়ী টাকা পাচার করছে কিনা, ফ্ল্যাট কিনছে কিনা। তাদের ফ্যাক্টরির খরচ কত, কর্মীদের বেতন কত, আমদানিতে কত লাগবে, তদারকিতে কত প্রয়োজন, সেই তহবিল ব্যবহারের সুযোগ তাদের দিতে হবে। কারণ ইমপোর্টার রিপ্লেস হয় না। ইমপোর্টে অভিজ্ঞতা লাগে। বাজার বুঝতে হয়। দেশে বিদেশে তাদের সব সেটআপ আছে। সুতরাং তাদের ডাইরেক্ট অ্যাটাক না করে ইনডাইরেক্ট ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ব্যবসায় কোন প্রভাব না পড়ে।
বার্তা২৪.কম: রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে দেশের বৃহৎ আমদানিকারকরা সরকারের রোষানলে পড়ায় আমদানি খাতে সৃষ্ট জটিলতায় কাঙ্খিত নিত্যপণ্য না আসায় ক্রমেই অস্থিতিশীল বাজার-এই দাবি পাইকারি বাজারের অনেকের। বাজারে পণ্য প্রবাহ স্বাভাবিক ও দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের কি করণীয়?
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস: আমার কাছে প্রধান কারণ এটি নয় যে আমদানিকারকদের বিরুদ্ধে সরকার লেগেছে তাই এমনটা হয়েছে। ইমপোর্ট কস্ট ও ডলারের ক্রাইসিস, এলসি রেসট্রিক করা-এগুলো তো আছেই। সবচেয়ে বড় কারণ হলো আমাদের ইন্টার্নাল মার্কেট ম্যানেজমেন্ট ইজ টোটাল ফেইলিয়র। এবিষয়ে কার্যকর তদারকি-মনিটরিং-পানিশমেন্ট-রিওয়ার্ড কিছুই নেই। ক্রিমিনাল অফেন্সের জন্য আমাদের পানিশমেন্ট খুবই নগণ্য। আমাদের বাজারে দুটি দিক দেখতে হবে। একটি হলো-ডিমান্ড সাইড, অন্যটি সাপ্লাই সাইড। আমরা যেসব পণ্য আমদানি করি সেগুলোর দাম বেড়ে যায় ডলার ক্রাইসিসের জন্য। পণ্য পরিবহনে বা সাপ্লাই চেইনটা ঠিক নেই বলেই পণ্যের দাম এভাবে বাড়ে। জিনিসের দাম বাড়ে যখন খরচ বেড়ে যায়। এখন সরকার যে নীতি নিয়েছে তা হচ্ছে-ডিমান্ড ম্যানেজমেন্ট। নীতি সুদের হার বাড়াচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এটা খুব ভালো পলিসি কিন্তু এতে কতদূর যাবে? ৬ মাসের বেশি যাবে না। আপনার যখন প্রবৃদ্ধি কমে যাবে তখন এত সুদ দিয়ে কেউ লোন নিতে পারবে না। এসব কারণে প্রবৃদ্ধি-কর্মসংস্থানের উপর প্রভাব পড়বে। এই পলিসি আরও বহু আগে নেওয়া উচিত ছিল। আগের গভর্নর নেননি, বর্তমান গভর্নর নিচ্ছেন তা ভালো পদক্ষেপ। কিন্তু উনারা আশা করছেন ৬ মাস পরে জিনিসপত্রের দাম কমবে। তখন আবার সুদের হার কমিয়ে দেওয়া হবে। তখন আবার বিনিয়োগ বাড়বে। কিন্তু এই বাজার এখন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। ছাত্ররা সমাজের লোকদের নিয়ে কিছু চেষ্টা করেছিল কিন্তু আবার পুরনো সিন্ডিকেটের মানসিকতা নতুন করে গড়ে উঠছে। আগে যারা চাঁদা নিত এখন অন্যরা বসেছে সেই জায়গায়। বেনাপোল থেকে বিভিন্ন পণ্য আনতে যেমন জায়গায় জায়গায় চাঁদা দিতে হতো এখনও দিতে হচ্ছে। সুতরাং গভর্ন্যান্স ঠিক না করলে বাজার ঠিক হবে না। জিনিসপত্রের দাম কমবে না।
বার্তা২৪.কম: সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বৃহৎ উদ্যোক্তা ও তাদের শিল্পকারখানা-বাড়িঘর সন্ত্রাসের শিকার হয়েছে। এভাবে অনেক প্রতিষ্ঠানেই বন্ধ হয়ে গেছে উৎপাদন ও সরবরাহ। বাজারে প্রভাব পড়ার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলির বিপুল সংখ্যক কর্মীর জীবন-জীবিকাও পড়েছে চরম অনিশ্চয়তায়। সামষ্টিক অর্থনীতিতে তা কি ধরণের প্রভাব ফেলতে পারে?
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস: খুব খারাপ প্রভাব পড়বে। এটা এভাবে এড্রেস হতে পারে না যে ওই শিল্পপতি বা তার শিল্প কারখানা পুড়িয়ে দিলাম-লুটপাট করলাম...এটা কোন সমাধান নয়। যদি ওই শিল্পের মালিক কোন অন্যায় করে থাকেন, ঋণ ফেরত না দিয়ে থাকেন; যদি তিনি ফ্যাসিবাদের সহযোগি হয়েও থাকেন, তার বিরুদ্ধে প্রচলিত নিয়ম-আইনকানুন আছে বিচার করার। কিন্তু এভাবে গাজী টায়ার ফ্যাক্টরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুর করা হচ্ছে। জিনিসপত্রের দামের চেয়ে জরুরি হচ্ছে ল অ্যান্ড অর্ডার সিচুয়েশন। ফ্যাসিবাদ বা স্বৈরাচারকেও মানুষ অনেক সময় পছন্দ করে কারণ এরা একটা পর্যায়ে স্ট্যাবিলিটি দেয়; এক পর্যায়ে তা ধরে রাখতে পারে না নানা সমীকরণে। মিলিটারি শাসন এলে আমরা খুশি হই, কারণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠান্ডা থাকে। কিন্তু এই সরকার তো তা ঠাণ্ডা করতে পারছে না। তাদের আমরা রেসপেক্ট করি কিন্তু এটা তো ঠিক যে গত দুই মাস হতে চললো, কিন্তু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুবই খারাপ। এই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপরই জিনিসপত্রের দাম সহ সব কিছু জড়িত। চাঁদাবাজি-গুণ্ডামি চলছে সবখানে। পোশাক কারখানায় কি চলছে? মালিক তো সব সময় লাভ করে, মালিক কখনও লস করে না। যা লস করে তা লাভের অংশ। আগে ২০ শতাংশ লাভ করতো এখন ১০ শতাংশ করে। কিন্তু ফ্যাক্টরিগুলোতে চলমান এই অশান্তির কি কারণ? কে এগুলো কন্ট্রোল করবে, কিভাবে করবে এ সরকার তা আমি বুঝি না? শিক্ষা খাত হ-য-ব-র-ল অবস্থা। একজন ধমক দিলেই ...। এই সরকারের উচিত এসব বিষয়ে কঠোর হওয়া।
বার্তা২৪.কম: ব্যাংকিং খাতকে স্থিতিশীল করতে অন্তবর্তী সরকারের পদক্ষেপকে কিভাবে দেখছেন?
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস: সো ফার সো গুড...যা করেছে ভালো করেছে। তাই করার কথা ছিল। গান পয়েন্টে ব্যাংক নিয়ে যেতে পারেন না। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে তারল্য সংকট থেকে বের করা, রিজার্ভ থেকে ডলার খরচ না করা, নতুন করে টাকা না ছাপানো-এগুলো খুবই ভালো পদক্ষেপ। আমি বিভিন্ন সময়ে এসব বিষয় নিয়ে সংবাদপত্রে লিখেছি। তখন সরকার বা সংশ্লিষ্টরা শুনে নাই। এখনকার সরকার বিশ^ব্যাংক আইএমএফ এর লোন নিয়ে খুব তুষ্ট। কিন্তু এসব লোন এক সময় কাল হবে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ তো আর এমনিতেই অর্থ ছাড় দেবে না। আপাততঃ ঘা’য়ের জায়গায় মলম লাগাতে হবে। সেই মলমটা লাগাচ্ছে। ব্যাংকিং খাত নিয়ে আপনার প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে-সো ফার সো গুড অন রাইট ট্র্যাক।
বার্তা২৪.কম: অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে যোগদান করে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন বলে জানানো হয়েছে। সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে চীনও। কিন্তু বৈশ্বিক ঋণফাঁদ নিয়ে চলমান বিতর্ক ও সেক্ষেত্রে সতকর্তা প্রশ্নে আপনার মূল্যায়ন কি?
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস: যদি ঠিক মতো ঋণ ব্যবহার করতে না পারেন তবে সব ঋণেরই ফাঁদ আছে। সেটা ক্ষুদ্রঋণ হোক কিংবা এসএমই বা বড় ঋণই হোক। এর আগে তো পাইপলাইনে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পড়ে আছে আগের পনের বছরের। ভালো প্রজেক্ট থাকলে তা এনে ডলার বৃদ্ধি করতে পারেন। দেখতে হবে আমাদের এবজর্বিং ক্যাপাসিটি কত? ক্যান ইউ ইউটিলাইট দোজ ফান্ড? আওয়ামীলীগ আমলে তো কম ঋণ নেয়নি। অনেক ঋণ নিয়েছে। তারপরও তো আমরা সন্তুষ্ট না। আওয়ামী লীগ নাকি অপব্যয় ও অপব্যবহার করেছে। বর্তমানে এই ঋণে একই কথা প্রযোজ্য। ঋণ তো দিবেই। ঋণ দেওয়ার জন্য তো চীন, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের লবিস্ট ঢাকায় বসে থাকেন। ঋণ কোন জায়গায়, কিভাবে দিবে? অর্থ উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন ‘হাত খুলে টাকা দিচ্ছে’ কিন্তু অর্থনীতিবিদ হিসাবে উনার বোঝা উচিত যে হাত খুলে ঋণ অনেকেই দিতে চায়। এটা তো তাদের একটা ব্যবসা। তারা সুদ পাবে, প্রিন্সিপাল অ্যামাউন্ট পাবে ইত্যাদি। এখন ইউনুস সাহেবের যেহেতু একটা লিংক আছে বিশে^র বিভিন্ন দেশের সঙ্গে, এদিকে কিছু রিসোর্স ডাইভার্ট করবে। আমার মূল প্রশ্ন হলো এই ৭ বিলিয়ন ডলার আমরা কোথায় খরচ করব? কোন প্রজেক্টে বিনিয়োগ করবে? পাইপলাইনে অর্থ আছে, সেগুলোই তো ব্যবহার করতে পারি না। ৭ বিলিয়ন বিনিয়োগ পেলে তা ভালো কথা, কিন্তু তো ব্যবহার করতে হবে? তারা তো টাকাটা এমনিতেই দিবে না। বলা হচ্ছে ব্যাংকিং খাত, ফিনিন্সিয়াল খাতে রিফর্মের কথা। জানা উচিত, কনসাল্টেন্সির নামে ৮০ পার্সেন্ট তারাই নিয়ে যাবে। ২০ পার্সেন্ট থাকবে এখানে। এইটাই আজীবন চলে আসছে। সুতরাং ঋণ পাইতেছি, ঋণ পাইতেছি...যে সরকারই আসুক ঋণ পাবে। সামনে বিএনপি আসলেও দেখবেন সবাই হাত বাড়িয়ে বলবে, কিভাবে সহযোগিতা করতে পারি?
বার্তা২৪.কম: কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি ভালো না হলে বৈদেশিক বিনিয়োগের সম্ভাবনা কতখানি?
অধ্যাপক আব্দুল বায়েস: যখন পূূর্বের সরকারের বিভিন্ন ইন্ডিকেটর নীচের দিকে যাচ্ছিল তখন বৈদেশিক সহায্য সংস্থাগুলো অনেকটা নীরবই ছিল। এখন তারা একটু উৎসাহিত। কিন্তু তাদের কিংবা আমাদের-কারোই ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে এটা অন্তবর্তী একটা সরকার। ইট হেস সাম পাওয়ার’ অনেকটা রুটিন ওয়ার্কের মতো। কিছু কিছু সংস্কার করবে। পুরো সংস্থারও তারা করতে পারবে না। আল্টিমেটলি উই হ্যাভ টু গো-ব্যাক টু পলিটিক্স। এই সাত বিলিয়ন ডলার ইউটিলাইজ করবেন পলিটিশিয়ানরা। এসব খরচ করার আইনি সুযোগও নেই তাদের। সবমিলিয়ে সংস্কারগুলো দ্রুত শেষ করে কিভাবে নির্বাচন দেওয়া যায় সেটাই জরুরি। বেড ডেমোক্রেসি ইজ বেটার দ্যান নো ডেমোক্রেসি।