বিদ্যুৎ চুরি ধরে ফেলাই কাল হলো ইউসুফ আলীর!
এক দশক ধরে চলা বিদ্যুৎ চুরি ধরে ফেলাই কাল হলো ইউসুফ আলীর। চুরির দায়ে অভিযুক্ত গ্রাহকের শাস্তি আর চুরি উদঘাটনে বিদ্যুতের কর্মী হিসেবে ইউসুফ আলীর পুরস্কার পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) করেছে উল্টো।
বিদ্যুৎ চুরির সঙ্গে জড়িত সিন্ডিকেট ধরা পড়ার ভয়ে টেকনিক্যাল সুপারভাইজার ইউসুফ আলীকেই চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। আর এতে হাস্যকর সব অভিযোগ আনা হয়েছে তার বিরুদ্ধে। যেগুলো তার কর্তৃত্ব কিংবা দায়ের মধ্যে পড়ে না। চাকরিচ্যুতির কারণ উল্লেখ করা হয়েছে, গ্রাহকের প্রকৃত বিদ্যুৎ ব্যবহার মিটারের প্রকৃত রিডিং সংগ্রহ না করা, অস্পষ্ট স্ন্যানশর্ট গ্রহণ করা।
ইউসুফ আলীও দমবার পাত্র নন, তিনিও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন। লিখিত আবেদন দিয়ে বলেছেন, মিটার রিডিং নেওয়া এবং স্ন্যানশর্ট গ্রহণ করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না। এগুলো কর্মাশিয়াল সুপারভাইজারের কাজ। তিনি এও লিখেছেন, আমার দায় থাকলে অবশ্যই শাস্তি মাথা পেতে নেবো। যদি না থাকে তাহলে আমার চাকরি ফেরত চাই।
যেভাবে ঘটনার সূত্রপাত
ইউসুফ আলী বার্তা২৪.কমকে বলেন, ইস্কাটন এলাকা প্রবাসী মুসা মজিদ (৪৩/এ) রেকর্ড অনুাযায়ী বাড়তি লোড ব্যবহার করছিলেন। নির্বাহী প্রকৌশলীর নির্দেশনায় অনুমোদনহীন বাড়তি লোড বৃদ্ধির জন্য চিঠি দিতে লাইনম্যানকে পাঠাই। লাইনম্যান সরেজমিন গিয়ে দু’টি মিটারেই ডাউন (বিলের তুলনায় অনেক কম রিডিং) পায়। লাইনম্যান ফোনে আমাকে জানালে দ্রুত ঘটনাস্থলে যাই। মিটার টেম্পারিংয়ের প্রমান পেলে সঙ্গে সঙ্গে নির্বাহী প্রকৌশলীকে অবগত করি। তারপর ডিপিডিসির কন্টোলরুম থেকে টিম এসে খুঁটি থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। প্রবাসী ওই গ্রাহকের ম্যানেজার আইয়ুব আলী মিটার টেম্পারিংয়ের কথা স্বীকার করে। এরপর মিটার দু’টি তার জিম্মায় দিয়ে আসি।
স্বীকারোক্তিতে আইয়ুব আলী উল্লেখ করেছেন, ‘বাসার গ্যারেজের মিটার দু’টির টেম্পারিং করি ৭/৮ বছর আগে। তখন থেকে প্রতিমাসে মিটার রিডারদের টাকা দিয়ে আসছি। বর্তমান মিটার রিডার আব্বাসের সঙ্গে মাসে ১০ হাজার টাকার সমঝোতা হয়। সেভাবে প্রতিমাসে ১০ হাজার টাকা দিয়ে আসছি। কোন ঝামেলা হলে সে দেখার কথা বলেছে।’
টেম্পারিং ধরা পড়ার পুর্বে (১৯২৬৬২২৬) মে (২০২৪) মাসে ব্যবহার দেখা যাচ্ছে ২৪৬ ইউনিট। তার আগের মাসে ছিল ২৬২ ইউনিট। সর্বোনিম্ন ১৪৪ থেকে সর্বোচ্চ ৪৭৭ ইউনিটের বিল করা হয়েছে। এরমধ্যেই বিল ওঠানামা করেছে। আর টেম্পারিংয়ের পর নতুন মিটার বসানোর ফলে অক্টোবর (২০২৪) মাসে ২৯৪০ এবং নভেম্বর ২৫০১ ইউনিট বিদ্যুতের বিপরীতে বিল এসেছে যথাক্রমে ৪২ হাজার ২৩৮ টাকা এবং ৩৬ হাজার ৫৬ টাকা। ওই মিটারে বিপরীতে ৮ বছর আগে (টেম্পারিংয়ের পুর্বে) ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার বিলের রেকর্ড পেয়েছে ডিপিডিসি। যা আগের মাসগুলোতে ২ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে ৪ হাজার টাকায় ওঠানামা করেছে। নতুন মিটার বসানোর পর শীতকালেও বিল এসেছে ৪২ হাজার টাকা অর্থাৎ প্রতিমাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকার বেশি বিদ্যুৎ চুরির ঘটনা ঘটেছে।
নিয়ম অনুযায়ী এমন ক্ষেত্রে মিটার পরীক্ষা করে জরিমানা করার কথা। প্রায় কোটি টাকার উপর জরিমানা হওয়ার কথা কিন্তু গ্রাহক মুসা মজিদের ক্ষেত্রে ঘটেছে ভিন্ন ঘটনা। কোনই জরিমানার খবর পাওয়া যায়নি শুধু সেই অপরাধ নয়, ইউসুফ আলীরা সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলেও ডিপিডিসির আরেকটি গ্রুপের সহায়তায় গোপনে লাইনটি অবৈধভাবে চালু করেন গ্রাহক।
অভিযোগ উঠেছে, অভিযুক্ত মুসা মজিদকে বাঁচাতে ডিপিডিসির আউটসোর্সিং কোম্পানির (মুন পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং) কোঅর্ডিনেটর মমিনুল হক, ডিপিডিসির কাকরাইল জোনের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হানিফ উদ্দিন ও ডিপিডিসির পরিচালক (এডমিন) সোনামনি চাকমা নানা রকম ষড়যন্ত্রে চালিয়ে যাচ্ছেন। ডিপিডিসির কাকরাইল জোন ও প্রধান কার্যালয়ের অনেকেই জড়িত রয়েছেন। জনশ্রুতি রয়েছে ১৬ লাখ টাকায় রফা হয় গ্রাহকের সঙ্গে। বিনিময়ে চুরি শনাক্ত করা ইউসুফ আলীকে চাকরিচ্যুত এবং অভিযুক্ত গ্রাহক মুসা মজিদ পেয়ে যান ক্লিন চিট।
কোঅর্ডিনেটর মমিনুল হক এ বিষয়ে বার্তা২৪.কম’কে বলেন, ‘আমি এর সঙ্গে জড়িত নই। অভিযুক্ত গ্রাহকের কোন জরিমানা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, নতুন করে তদন্ত কমিটি হয়েছে তারা বলতে পারবে। তার আগে কোন জরিমানা হওয়ার কোন তথ্য আমি শুনিনি।’
ডিপিডিসি কাকরাইল জোনের তৎকালীন নির্বাহী প্রকৌশলী মেহেদী হাসানকে বদলী করে টঙ্গী স্টোর ম্যানেজমেন্ট বিভাগে বদলী করা হয়েছে। তিনি বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘জরিমানার বিষয়টি আমরা নির্ধারণ করতে পারছিলাম না, তাই মিটারিং ডিভিশনে প্রেরণ করা হয়। তারা বিষয়টি বলতে পারবে। তবে আমি থাকা পর্যন্ত কোন জরিমানা করা হয় নি।’
এক সময়ে রাজধানী ঢাকা ও পাশ্ববর্তী, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে বিদ্যুৎ বিতরণের একক দায়িত্ব ছিল ডেসার (ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কর্তৃপক্ষ) হাতে। সংস্থাটি ব্যাপক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লে ভেঙে দু’টি কোম্পানি গঠন করা হয়। উত্তরের দায়িত্ব পাওয়া কোম্পানির নাম দেওয়া হয় ডেসকো। আর দক্ষিণের দায়িত্ব পায় ডিপিডিসি।
ডেসা থেকে সকল সম্পদ ও দায় দায়িত্ব গ্রহণ করে ২০০৮ সালের ১ জুলাই বাণিজ্যিকভাবে অপারেশন শুরু করে। ডিপিডিসি ৬ লাখ ৫৫ হাজার ৯০৮ জন গ্রাহক নিয়ে তার অপারেশন শুরু করলেও বর্তমানে গ্রাহকের সংখ্যা ১৮ লাখ ২৯ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। কথিত রয়েছে, ডেসার সংখ্যাধিক্য দুর্নীতিবাজ রয়ে যায় ডিপিডিসি’তে। যে কারণে এই কোম্পানিটি সিস্টেম লসসহ নানা দিক থেকে থেকে পিছিয়ে রয়েছে। অসাধু সিন্ডিকেট কতটা সক্রিয় তার উপযুক্ত উদাহরণ হতে পারে ইউসুফ আলীর ঘটনা।