সমাজে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনরা। খুব বেশি অসুস্থ না হলে সব প্রতিকূল পরিবেশেই দায়িত্ব পালন করতে হয় তাদের। যুগের পর যুগ নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেও তাদের বেশিরভাগই রয়ে গেছেন পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর তালিকায়। মসজিদ কমিটি থেকে তাদেরকে যে বেতন দেওয়া হয়, তা দিয়ে সংসার চালানোই যেন দায়। ‘আল্লাহ চালিয়ে নিচ্ছেন’ বলে নিয়তিকে মেনে নিয়ে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তারা।
কেমন বেতন পান ইমাম-মোয়াজ্জিনরা
দেশের ৬৪ জেলায় প্রায় সাড়ে ৩ লাখ মসজিদ রয়েছে। এসবে প্রায় ১৭ লাখ ইমাম-মোয়াজ্জিন ও খাদেম কর্মরত রয়েছেন। এর মধ্যে বায়তুল মোকারম জাতীয় মসজিদ, চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ এবং জমিয়াতুল ফালাহ মসজিদে তিনজন খতিব, ছয়জন পেশ ইমাম ও ছয়জন মোয়াজ্জিনের বেতন-ভাতা সরকারিভাবে দেওয়া হয়। এর বাইরে মডেল মসজিদগুলোতে ইমাম, মোয়াজ্জিন ও খাদেমরা (দুইজন) যথাক্রমে ১৫ হাজার, ১০ হাজার ও ৭ হাজার ৫০০ টাকা করে বেতন পান।
অন্যদিকে শহরে ও গ্রামে-গঞ্জে যেসব মসজিদ রয়েছে সেগুলো সমাজের মসজিদ কমিটির মাধ্যমে পরিচালিত হয়। স্থানীয় কমিটির মাধ্যমে আয়কৃত টাকা থেকে দেওয়া হয় মসজিদের ইমাম ও মোয়াজ্জিনদের বেতনভাতা। তবে তাদের যে পরিমাণ বেতন-ভাতা দেওয়া হয়, তা উল্লেখ না করলেই ভদ্রতা বজায় থাকে। আবার শহরের মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন ও খাদেমরা মাসিকভিত্তিতে কিছু সম্মানী পেলেও অনেক গ্রামের মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিনরা বাৎসরিক এককালীন বেতন পেয়ে থাকেন। তবে সব জায়গায় ইমাম-মোয়াজ্জিনে ও খাদেমদের দৈনিক খাবারের ব্যবস্থা করা হয় মহল্লার পক্ষ থেকে। সেটা আরেক ফিরিস্তি।
এর বাইরে মসজিদ সংলগ্ন মক্তব, মাদরাসায় শিক্ষকতা ও টিউশনি করে কেউ বাড়তি আয় করেন। অনেকে ইসলামিক ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা প্রকল্পে কাজ করেন। এ প্রকল্পে ৪৯ হাজার ৭১৯ জন ইমাম ও মোয়াজ্জিন কর্মরত, তাদের প্রতি মাসে ৫ হাজার টাকা হারে সম্মানী দেওয়া হয়। এটা মসজিদ থেকে প্রাপ্ত সম্মানীর অতিরিক্ত।
বেশ কয়েকজন ইমাম-মোয়াজ্জিন ও মসজিদ পরিচালনা কমিটির সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইমাম-মোয়াজ্জিনরা যে বেতন পান; তা দিয়ে সংসার চলছে না। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে চলতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়লেও বেতন বাড়েনি তাদের। বেশিরভাগ দিনই পরিবার নিয়ে ডাল-সবজি খেয়ে জীবনযাপন করছেন তারা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ইমাম বলেন, আমি যেভাবে চলতেছি আল্লাহর রহমতে ভালোই চলতেছি। তবে যে সাত হাজার টাকা বেতন পাই, তা দিয়ে পরিবারের চাহিদা মেটাতে পারছি না। আর বাজারে যে জিনিসটা কিনতে চাচ্ছি, সেটা কিনতে পারছি না। কয়েক দিন আগে বাজারে এক কেজি গোশত কিনতে গিয়েছি, দেখি গোশতের দাম হয়ে গেছে ৮০০ টাকা। ভাগ্য হয়নি আমার সে গোস্ত কেনার। ওই অবস্থায় বাড়িতে চলে আসি।
মসজিদ পরিচালনা কমিটির দায়িত্ব
যারা মসজিদ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করেন, তারা একটি গুরুদায়িত্ব পালন করেন। আর যে দায়িত্ব যত গুরুত্ববহ, ওই দায়িত্ব নিয়ম মোতাবেক সুষ্ঠুভাবে পালন করলে যেমন সওয়াব বেশি, তেমনি তা পালনে ইচ্ছাকৃতভাবে অনিয়ম ও ত্রুটি করলে পাপের মাত্রাও বেশি।
দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের দেশে মসজিদ পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকেন অর্থাৎ, পরিচালনা কমিটিতে যারা থাকেন, তারা অনেক কিছু নিজেদের খেয়াল-খুশিমতো করেন, তার একটি হলো- মসজিদের স্টাফদের বেতন-ভাতায় অবিচার।
যেসব মসজিদে ফান্ডের ঘাটতি থাকার ফলে পরিচালনা কমিটি আন্তরিক ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও স্টাফের উপযুক্ত বেতন-ভাতা দিতে পারে না, আশা করা যায়- চেষ্টা করে যাওয়ার শর্তে আল্লাহর কাছে ক্ষমা পেয়ে যাবেন। কিন্তু ফান্ডের ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও যেখানে পরিচালনা কমিটি স্টাফের উপযুক্ত বেতন-ভাতা দিতে ত্রুটি করবে, অবহেলা বা গোঁয়ার্তুমি করে স্টাফের প্রতি অবিচার চালিয়ে যাবে, নিঃসন্দেহে সেই পরিচালনা কমিটির লোকজন বান্দার হক নষ্ট করার কারণে কবিরা গোনাহে আক্রান্ত হবেন। যদি তারা এটাকে গোনাহই মনে না করেন, তাহলে তা হবে আরও মারাত্মক গোনাহ।
মনে রাখতে হবে, এটা বান্দার হক নষ্ট করার কারণে গোনাহ। আর বান্দার হক নষ্ট করা এমন গোনাহ যে সংশ্লিষ্ট বান্দা সেটা মাফ না করলে আল্লাহরও তা মাফ করবেন না।
অনেক কমিটির লোকজন মসজিদের ভবন নির্মাণ, সাজসজ্জা প্রভৃতি বৈষয়িক কাজে টাকা ব্যয় করতে পারাকে তারা কাজের কাজ মনে করেন। পক্ষান্তরে স্টাফের বেতন-ভাতা দেওয়া যেন তাদের কাছে একটা গুরুত্বহীন কাজে ব্যয় করা। এ কারণে জেনারেল ফান্ডের অর্থ, যা দিয়ে স্টাফের বেতন-ভাতা দেওয়া যায়, তা এলেই তা ইমারত নির্মাণ প্রভৃতি বৈষয়িক কাজে ব্যয় করে ফেলেন। ফলে স্টাফের বেতন-ভাতা প্রদানের মতো অর্থের ঘাটতি সৃষ্টি হয়।
এটা ভারসাম্যহীনতা। মনে রাখতে হবে, স্টাফের বেতন-ভাতা প্রদান করা ওয়াজিব। পক্ষান্তরে ইমারত নির্মাণ প্রভৃতি বৈষয়িক জাঁকজমক ফরজ বা ওয়াজিব পর্যায়ের বিষয় নয়। এসব ক্ষেত্রে যতটুকু একান্তই না হলে নয় ততটুকু সম্পন্ন হওয়ার পর জেনারেল ফান্ডের অর্থ দিয়ে আগে স্টাফের বেতন-ভাতা পরিশোধ করে নেওয়া চাই। তবে হ্যাঁ, মানুষের কাছ থেকে নির্দিষ্টভাবে কনস্ট্রাকশন খাতের জন্যই যদি কোনো অর্থ আদায় হয়, তাহলে সেটা সেই খাতেই ব্যয় হবে।
মসজিদের স্টাফদের উপযুক্ত বেতন-ভাতা না দেওয়ার ফলে স্টাফের অনেকে দায়িত্ব পালনে অনীহার শিকার হন, অনেকে অনন্যোপায় হয়ে আরও কিছু উপার্জনের তাগিদে যে সময় ও মেধা প্রতিষ্ঠানের জন্য ব্যয় করতে পারত তা অন্যভাবে উপার্জনের পেছনে ব্যয় করে। এভাবে মসজিদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনেকে নাজায়েজ বা অনপুযুক্ত পদ্ধতিতে উপার্জনের পথে অগ্রসর হয়। অনেক এমন দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়। এসব নেতিবাচকতার দায়ও পরিচালনা কমিটি এড়াতে পারেন না।
যেসব এলাকায় মসজিদদের স্টাফদের বেতন-ভাতায় অবিচার হচ্ছে, সেখানকার অধিবাসীদেরও দায়িত্ব এরূপ অবিচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া। বৈষম্য নিরসনে কাজ করা।
মসজিদের ইমাম-মোয়াজ্জিন ও খাদেমদের মাসিক বেতন-ভাতার পরিমাণ ঠিক কী হওয়া চাই, এটা কোনো মূলনীতি দিয়ে নির্ধারিত হওয়ার বিষয় নয়। এটা অবস্থা, স্থান ও কালভেদে পরিবর্তনশীল। শহর ও অভিজাত এলাকায় সক্ষমতা সাপেক্ষে সম্মানজনক হাদিয়া নির্ধারণ করাই শ্রেয়। সুবিবেচনাই এ ক্ষেত্রে সঠিক ফায়সালা এনে দেবে।
আল্লাহতায়ালা আমাদের সবাইকে সুমতি দান করুন, ভারসাম্য দান করুন। আমিন!