আগুনের আলাদা কোনো পরিচয় নেই

  • আহমদ ইবসাইস
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পালিসেডসের অগ্নিকাণ্ডের একটি দৃশ্য, ছবি: সংগৃহীত

পালিসেডসের অগ্নিকাণ্ডের একটি দৃশ্য, ছবি: সংগৃহীত

দখলে জর্জরিত ফিলিস্তিনের গাজার ধ্বংসস্তুপ এবং লস অ্যাঞ্জেলেসে চলমান আগুন থেকে বিশ্ব মানবতার অনেক কিছু শেখার রয়েছে। গাজার আগুন মানুষ সৃষ্ট, সেখানে বিশ্ব বিবেক নির্বিকার। লস অ্যাঞ্জেলেসসহ আমেরিকার নেতৃবৃন্দ এই আগুনের মদদদাতা।

আর লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুন প্রাকৃতিক। পরিবেশগত নানা বিষয়কে এই আগুনের জন্য দায়ী করা হলেও এই আগুনকে মানুষ দয়ার চোখে দেখছে না। অন্তত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো। অনেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের আগুনকে গাজার প্রতি মার্কিনিদের মনোভাবের প্রাকৃতিক প্রতিশোধ হিসেবে বলার চেষ্টা করছেন। কারণ, আমেরিকানদের বিশ্ব শাসন ব্যবস্থা সংরক্ষণের চেয়ে বিজয়, মানুষের চেয়ে মুনাফা এবং অস্তিত্বের চেয়ে সম্প্রসারণকে বেশি মূল্য দেয়। যা গাহা নীতির ক্ষেত্রে প্রকাশ পেয়েছে।

বিজ্ঞাপন

গত কয়েকদিন ধরে আমি আমার ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখছি কিভাবে ঘরবাড়ি, ইতিহাস এবং স্মৃতিগুলো পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু এবার এটি গাজা নয়। আমি পালিসেডসকে পুড়তে দেখছি। পাহাড়গুলো যেন আগুনে বেঁচে আছে, আরেকটি ধ্বংসযজ্ঞের প্রতিধ্বনি যা হাজার মাইল দূরে চলমান। গত পনেরো মাস ধরে আমি টেলিভিশনের পর্দা ও খবরের শিরোনামের মাধ্যমে গাজার ভূমি ও মানুষকে পুড়তে দেখেছি। এখন আমি যখন একটি আমেরিকান শহরের আকাশ ধোঁয়ায় ভরে যেতে দেখি, তখন এই বিপর্যয়গুলোর মধ্যকার দূরত্ব এক হয়ে একটি তীব্র সত্যে পরিণত হয়। এই আগুনগুলো ধ্বংসের একই ভাষায় কথা বলে– ঔপনিবেশিকতা।

পালিসেডসের আগুন শুধু ক্যালিফোর্নিয়ার বন্য আগুন নয়, এটি একটি আয়না। যা সংযুক্ত বিপর্যয়ের বৈশ্বিক সংকটকে প্রতিফলিত করে। যখন আমি চোখ বন্ধ করি, চিত্রগুলো একসঙ্গে মিলে যায়। ক্যালিফোর্নিয়ার জ্বলন্ত পাহাড়, গাজা এবং ঐতিহাসিক প্যালেস্টাইনের জ্বলন্ত জলপাই বাগান, ধোঁয়ায় ঢাকা দিগন্ত- যা কোনো সীমান্ত চেনে না।

বিজ্ঞাপন

ল্যাঙ্কাস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দেখিয়েছে যে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পরের প্রথম ষাট দিনে গাজার সামরিক প্রতিক্রিয়া এমন গ্রিনহাউস গ্যাস উৎপন্ন করেছিল যা বিশটি জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশের বার্ষিক নির্গমনের সমান। শুধু অক্টোবরে ইসরায়েল গাজায় ২৫ হাজার টন বোমা ফেলেছিল, যা ১,৫০,০০০ টন কয়লা পোড়ানোর সমতুল্য গ্রিনহাউস গ্যাস মুক্তি দিয়েছে। ডিসেম্বরের মধ্যে অস্ত্র সরবরাহকারী মার্কিন কার্গো ফ্লাইটগুলো ৫০ মিলিয়ন লিটার জেট জ্বালানি খরচ করেছিল, যা ১,৩৩,০০০ টন কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গত করেছিল- যা গ্রেনাডার বার্ষিক নির্গমনের চেয়েও বেশি।

এই পরিবেশগত বিপর্যয় শুধু চলমান গণহত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়নি। কয়েক দশক ধরে ফিলিস্তিনিরা তাদের পরিবেশের সঙ্গে টেকসইভাবে বসবাস ও কাজ করছিল, আদিবাসী ভূদৃশ্য বজায় রেখে তরমুজ থেকে জলপাই পর্যন্ত বিভিন্ন ফসল উৎপাদন করছিল। ১৯৬৭ সাল থেকে, ইসরায়েল দখলকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলে অন্তত ২৫ লাখ গাছ উপড়ে ফেলেছে, যার মধ্যে প্রায় ১০ লাখ জলপাই গাছ ছিল, যা অনেক ফিলিস্তিনির খাদ্য ও আয়ের প্রধান উৎস। ইসরায়েল এই গাছগুলো পরিবর্তন করে ইউরোপ থেকে আমদানিকৃত গাছ দিয়ে, যা সম্ভবত তাদের ইউরোপীয় শিকড়ের প্রতিফলন।

যখন আমরা যুদ্ধের পরিকাঠামোর জলবায়ু খরচ অন্তর্ভুক্ত করি- সুড়ঙ্গ, দেয়াল, সামরিক স্থাপনা– তখন মোট পরিমাণ ৪৫০,০০০ মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড সমতুল্য, যা ৩৩টি দেশের বার্ষিক নির্গমনের চেয়েও বেশি।

গাজার কৃষকদের কথা ভাবি, যারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ১৭০ বর্গকিলোমিটার উর্বর জমি চাষ করতেন। এখন স্যাটেলাইট চিত্রগুলোতে দেখা যায় বাগানের জায়গায় এক ধ্বংসস্তূপ।

পৃথিবীর ক্ষত আমাদের নিজস্ব ক্ষত। গাজায় যা সহ্য করা হয়, তা সর্বত্র সহ্য করা হয়। আজ তাদের ক্ষেতগুলো হাজার পাউন্ডের বোমার নিচে পুড়ছে, কাল আমাদের বনভূমি। আমাদের মধ্যে সংযোগকারী আগুনগুলো এই সত্যটি দেখানোর দাবি করে। আমরা হয় একসঙ্গে দাঁড়াবো এই ধ্বংসের বিরুদ্ধে, অথবা আমরা আলাদা আলাদা পুড়ব।

গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে শুরু হওয়া গাজা হামলায় মোট মৃতের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৬০০ জন। এ সময়ে আহত হয়েছেন অন্তত এক লাখ ৯ হাজার ৫৭১ ফিলিস্তিনি। তবে প্রকৃত নিহত ও আহতের সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, এখনও অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে ও রাস্তায় আটকা পড়ে আছে। উদ্ধারকারীরা তাদের কাছে পৌঁছাতে না পারায় সঠিক সংখ্যা বলা যাচ্ছে না।

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় এক বছরের বেশি সময় ধরে হামলা চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। দেশটির অব্যাহত এ হামলায় সৃষ্ট ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে অন্তত ১৫ বছর সময় লাগবে। এ জন্য প্রতিদিন ১০০টি লরি ব্যবহার করতে হবে।

জাতিসঙ্ঘের হিসাব মতে, গাজায় ভবন ধসে এ পর্যন্ত ৪২ মিলিয়ন টনেরও বেশি ধ্বংসস্তূপ জমা হয়েছে। এ ধ্বংসস্তূপগুলো যদি একসঙ্গে এক জায়গায় রাখা যায়, তাহলে তা মিসরের ১১টি গ্রেট পিরামিডের সমান হবে। এ ধ্বংসস্তূপ সরাতে ব্যয় হবে ৫০০ থেকে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৭ হাজার কোটি টাকার বেশি)।

ইউএন এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের হিসাব অনুসারে, গাজায় ১ লাখ ৩৭ হাজার ২৯৭টি ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, যা অঞ্চলটির মোট ভবনের অর্ধেকের বেশি। ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। এ ছাড়া এক-দশমাংশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং এক-তৃতীয়াংশ বেশ খানিকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব ভবনের ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে ফেলার জন্য ২৫০ থেকে ৫০০ হেক্টর জমির প্রয়োজন পড়বে।

আহমদ ইবসাইস: ফিলিস্তিনি আমেরিকান ও আইনের ছাত্র।