আর্থসামাজিক উন্নয়নে এনজিওগুলোর কী সংস্কার প্রয়োজন

  • নিউজ ডেস্ক, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীনতার পর থেকে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন (এনজিও) বা বেসরকারি সংস্থা কাজ করে আসছে। বিশেষ করে গ্রামীণ আর্থসামাজিক উন্নয়নে এসব সংস্থার ভূমিকা কম নয়। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর পার হওয়ার পর এনজিওর কার্যপরিধি বাড়লেও সামাজিক উন্নয়নের মূল জায়গা থেকেও এনজিওগুলো ক্রমেই সরে যাচ্ছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, প্রান্তিক মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নের মতো উদ্যোগ থেকে সরে এসে দেশের বৃহদাকারের এনজিওগুলো এখন করপোরেট কালচারের দিকে যাচ্ছে।

এনজিও বলতে সারা দেশের মানুষের ধারণা হলো-বৈদেশিক সাহায্যে পরিপুষ্ট প্রতিষ্ঠান যারা দেশের দুর্দশাগ্রস্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে কোনো না কোনোভাবে সাহায্য-সহযোগিতাসহ দেশের উন্নয়নের জন্যও কাজ করে।

বিজ্ঞাপন

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী- দেশে বর্তমানে ছোটবড়সহ প্রায় ৪৫ হাজার এনজিও রয়েছে। তবে এনজিও-বিষয়ক ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্যে ২ হাজার ৬৩৬টি রেজিস্টার্ড এনজিওর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

গত শতাব্দীর আশি ও নব্বইয়ের দশকে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিওর দ্রুত বিকাশের কারণে বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি গ্রামে এনজিও কার্যক্রম পরিচালিত হতে শুরু করে অদ্যাবধি চলে আসছে। দেশে স্থানীয় বৃহৎ এনজিওর মধ্যে ব্র্যাক, গ্রামীণ, প্রশিকা, টিএমএসএস, আশা, কারিতাস, আরডিআরএস বাংলাদেশ, ব্যুরো বাংলাদেশ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বেসরকারি এসব উন্নয়ন সংস্থা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে ক্ষুদ্রঋণসহ বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে। এনজিওগুলো মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রমের মাধ্যমে দরিদ্রদের, বিশেষ করে নারীদের কাছে সহজেই পৌঁছে যায়। একই সঙ্গে অর্থ উৎপাদনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত হওয়ায় এনজিওগুলোকে টেকসই ও দীর্ঘস্থায়ী হতে সহযোগিতা করছে।

এছাড়াও এনজিওগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবাধিকার, পরিবার পরিকল্পনা, পরিবেশ এবং নারী ও শিশু কল্যাণসহ অন্যান্য কাজ করে থাকে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় এনজিওগুলোর লক্ষ্য পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। তারা বলেন, এনজিওগুলোর ফোকাস এখন জাতীয় উন্নয়নের দিকে মোড় নিয়েছে। যার ফলে তাদের এখন উন্নয়নের অংশীদার হিসেবে তুলে ধরা হয়।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, এনজিওরা দেশের উন্নয়নে অনেক অবদান রাখলেও তাদের কোনও স্বীকৃতি ছিল না। ফলে দেশের মানুষও তাদের অবদান সম্পর্কে জানতে পারেনি।

এনজিওর কার্যক্রম নিয়ে অধিকার ও উন্নয়নকর্মী খুশী কবির বলেন, আমাদের দেশে ছোট বা বড় হোক অধিকাংশ এনজিও মাইক্রো ফাইন্যান্স নিয়ে কাজ করে। মাইক্রোক্রেডিট যারা করেন তাদের জন্য কর্তৃপক্ষ আছে। আর যারা বিদেশ থেকে টাকা এনে কাজ করে তাদের জন্য আছে এনজিও ব্যুরো। এদের অনুমতি ছাড়া অর্থ নিয়ে আসা যায় না। এ ধরনের কিছু ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এ ব্যবস্থাগুলো ঠিকমতো কাজ করছে কিনা সেটা দেখতে হবে। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মতো এনজিওর জবাবদিহিতা দরকার বলে মনে করেন তিনি।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে এনজিওর সংস্কার প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেন খুশী কবির। বলেন, যত জবাবদিহিতা এবং সুশাসনের স্বচ্ছতা থাকুক সেটা প্রত্যেকটি সংস্থা ও ব্যক্তির জন্য প্রযোজ্য। এনজিও খাতের সংস্কার নির্ভর করবে দুটি জায়গায়। এ খাতে যারা আছেন তারা যদি মনে করেন সংস্কারের প্রয়োজন আছে আর দ্বিতীয় হলো যাদের সঙ্গে এনজিও কাজ করে তারা কি মনে করেন সেটা? অধিকাংশ এনজিও এখন মাইক্রোক্রেডিট সেবা দেয়। এক্ষেত্রে অস্পষ্টতার সুযোগ অনেক আছে।

এ বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমীন এস মুরশিদ বলেন, রাষ্ট্রের যেমন সংস্কার হওয়া প্রয়োজন, ঠিক একই সংস্কার এনজিওগুলোরও হওয়া প্রয়োজন। এনজিওর ভেতরেও অনেকগুলো স্কোপ রয়েছে। এখানে স্বচ্ছতা আরও আসতে পারে। যদিও সরকারের শাসন ব্যবস্থার চেয়ে এনজিওগুলোর স্বচ্ছতা তুলনামূলক বেশি। এনজিওগুলো বিশেষ ভূমিকা পালন করে, যেটা সরকারের ঘাটতি পূরণে ভীষণ সাহায্য করে।

তিনি আরও বলেন, আমাদের সুশাসনের ঘাটতি আছে। আরো দক্ষ ব্যবস্থাপনায় আসা উচিত। বড় এনজিওগুলো এখন করপোরেট ম্যানেজমেন্ট কিছুটা আত্মস্থ করে নিয়েছে কিন্তু ছোটগুলো সেভাবে পারেনি। অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনা, দক্ষতা, সুশাসনে এনজিওগুলোর ঘাটতি আছে। এগুলো আরও এফিশিয়েন্ট করা দরকার। গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হলো রাষ্ট্র এনজিওকে নিয়ে কী করতে চায়। আর এনজিওগুলো কীভাবে রাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে চায়। এ জায়গায় নতুন করে দেখা খুব দরকার।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী- ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে এনজিওগুলো ক্ষুদ্র ঋণ বাবদ ১ লাখ ৬০ হাজার ৭৭০ কোটি টাকা বিতরণ করেছে। এই ঋণের ৪৩ শতাংশই বিতরণ করেছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক। আশা বিতরণ করেছে ৩১ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ১৫ দশমিক ৩৫ শতাংশ বিতরণ হয়েছে। টিএমএসএস, প্রশিকা, আরডিআরএস বাংলাদেশ ও কারিতাস বিতরণ করেছে যথাক্রমে ৫ দশমিক ৯০, ১ দশমিক ৪৯, ১ দশমিক ৪২ এবং শূন্য দশমিক ৫৫ শতাংশ ক্ষুদ্র ঋণ।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে স্যার ফজলে হাসান আবেদ ব্র্যাক নামে একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। গ্রামীণ শিশুদের শিক্ষা, গ্রামীণ দরিদ্র বিশেষত নারীপ্রধান অতিদরিদ্র পরিবারের আর্থসামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচন করাসহ নানা ধরনের আর্থসামাজিক কার্যক্রম নিয়ে দশক দুইয়ের মধ্যেই শক্ত একটি অবস্থান দাঁড় করেছিল প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তী সময়ে গ্রামীণ মানুষের কাছ থেকে উৎপাদিত পণ্য নিজেরাই বাজারজাত করতে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসার প্রসার ঘটতে থাকে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটি গত অর্থবছরে ৭০ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করেছে।

বিনা জামানতে গ্রামীণ ভূমিহীন মানুষকে ঋণ সুবিধা দিতে ১৯৮৩ সালের ২ অক্টোবর ব্যাংক হিসেবে আনুষ্ঠানিক জন্ম হয় গ্রামীণ ব্যাংকের। যার প্রতিষ্ঠাতা নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার এ সামাজিক উদ্যোগকে দেশ ও দেশের বাইরে ছড়িয়ে দিতে তিনি প্রায় অর্ধশত প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে সরকারের গঠন করা রিভিউ কমিটির প্রতিবেদন অনুসারে সব মিলিয়ে ৪৮টি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তারা পর্ষদ পরিচালক ও চেয়ারম্যান হিসেবে রয়েছেন। গ্রামীণ ব্যাংক ১৯৯৪ সালে গ্রামীণ ফান্ড নামে একটি সীমিত দায়ের অলাভজনক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে। নোরাড, সিআইডিএ, এসআইডিএ, ইউএস এইড ও ফোর্ড ফাউন্ডেশনের অর্থ সাহায্যে গঠিত সোশ্যাল ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফান্ড (এসভিসিএফ) থেকে গ্রামীণ ফান্ড প্রতিষ্ঠা করার সময় ৪৯ কোটি ১০ লাখ টাকা স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তী সময়ে এসভিসিএফ ফান্ড থেকে ৪৪ কোটি ২৫ লাখ টাকা স্থানান্তরের মাধ্যমে গ্রামীণ ব্যাংকের উদ্যোগে গ্রামীণ কল্যাণ নামে আরেকটি অলাভজনক সীমিত দায়ের কোম্পানি গঠন করা হয় ১৯৯৬ সালে।

পরবর্তী সময়ে এই গ্রামীণ ফান্ড ও গ্রামীণ কল্যাণের একক ও যৌথ উদ্যোগে ইকুইটি ও ঋণ সহায়তার মাধ্যমে ৩৪টি প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। এছাড়া ড. মুহাম্মদ ইউনূসের উদ্যোগে দেশে-বিদেশে আরো ১১টি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়। এর মধ্যে গ্রামীণ ফান্ড ১৫টি ও গ্রামীণ কল্যাণ ১৩টি প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়ন করছে। গ্রামীণ কল্যাণের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ টেলিকম আরো ১২টি প্রতিষ্ঠানকে অর্থায়ন করছে।

দেশের দারিদ্র্য বিমোচন, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, চিকিৎসা—এসব সামাজিক কাজের জন্য এনজিও শুরু হয়েছিল বলে জানান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, আমরা গবেষণায় দেখেছি, আশির দশকের পর থেকে এনজিওর মধ্যে তিন ধরনের প্রবণতা। একটা হলো পশ্চাদপসরণ, অর্থাৎ তাদের আদি প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার বা ঘোষণা থেকে পশ্চাদপসরণ হয়ে আর্থিক কর্মকাণ্ডে চলে যায়। আরেকটা হচ্ছে অঙ্গীভবন, অর্থাৎ রাষ্ট্রের সঙ্গে বা সরকারের সঙ্গে ইন্টিগ্রেটেড হয়ে যায়। এভাবে তারা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির একটা অংশ হয়ে যায়। প্রথমে যেখানে শোষণ-নিপীড়ন দিয়ে কথাবার্তা হতো, রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে আসার কারণে একটা নির্দিষ্ট ব্যবস্থার মধ্যে থেকে নিরাপদ কাজ বেছে নিচ্ছে সংস্থাগুলো। তৃতীয় প্রবণতা হলো করপোরেটাইজেশন, বলা যায় একচেটিয়াকরণ। কিছু এনজিও বাণিজ্যিক সাফল্যের মধ্য দিয়ে বিশাল আকার ধারণ করল, বাকিরা তাদের সাব-কন্ট্রাক্টর হয়ে গেল। এ তিনটি প্রবণতার মধ্য দিয়ে এখন আমরা করপোরেট এনজিওর একটা উত্থান দেখতে পাচ্ছি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) ২০১৮ সালে এনজিওগুলোর সুশাসন নিয়ে একটি অনুসন্ধান চালায়। এ বিষয়ে প্রকাশিত তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈদেশিক অর্থায়নে পরিচালিত বাংলাদেশের এনজিও খাতে সুশাসনের ক্ষেত্রে বেশকিছু ইতিবাচক চর্চা অর্জিত হলেও এখনো উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বলা হয়, বেশির ভাগ এনজিওর লোকাল লেভেল বোর্ডের সদস্যরা প্রধান নির্বাহীর আত্মীর ও বন্ধু-বান্ধব হয়ে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে প্রধান নির্বাহী বোর্ড মিটিং না ডেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। বণিক বার্তা