ব্যাপক বদলিতে ডিএমপির সেবা ব্যাহত, অলিগলি চেনেন না নতুন আসা এসআইরা
বাংলাদেশের প্রাণকেন্দ্র রাজধানী ঢাকা। ঢাকাকে বলা হয় ৫২ বাজার ৫৩ গলির শহর। দুই কোটিরও বেশি জনসংখ্যার শহরে প্রতিনিয়তই ঘটছে নানা অপরাধ। রাজধানী জুড়ে তীক্ষ্ণ নজর রাখা পুলিশ বাহিনী গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে অনেকটাই নিষ্ক্রিয়। এরই মধ্যে এসেছে দেশের পুলিশের সবচেয়ে বড় ইউনিট ডিএমপিতে ব্যাপক বদলি।
জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের হয়ে হত্যাযজ্ঞ চালানোর দায়ে ইতোমধ্যে চাকরি হারানো ও গ্রেফতার হয়েছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। আবার গ্রেফতার থেকে বাঁচতে আত্মগোপনেও রয়েছেন ঊর্ধ্বতন বহু কর্মকর্তা। আর যারা কাজে যোগ দিয়েছেন তাদের সবাইকে ডিএমপির বাইরে বিভিন্ন রেঞ্জ ও ইউনিটে বদলি করা হচ্ছে। যার প্রভাব পড়েছে মাঠ-পুলিশিংয়ে। আর এই সুযোগে রাজধানী জুড়ে বেড়েছে অপরাধীদের দৌরাত্ম্য। চুরি ছিনতাইসহ ঘটছে ডাকাতির মতো ঘটনা।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে ডিএমপিতে কর্মরত সবাইকে এক সঙ্গে বদলি করা সঠিক হয়নি। যে সকল পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ সরকারের ঘনিষ্ঠতা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরাসরি গুলি চালানো বা হামলার অভিযোগ রয়েছে তাদের বদলি করে যারা নিরপেক্ষ ও পেশাদার রয়েছেন তাদের ডিএমপির ভেতরে পদায়ন করে রাখা যেতো। কারণ জেলা পুলিশ ও ডিএমপি পুলিশিং এক না, অপরাধের ভিন্নতা রয়েছে। বরং বিভিন্ন জেলা ও রেঞ্জ থেকে ডিএমপিতে আসা অনেক কর্মকর্তাই তাদের কাজ বুঝেই ওঠতে পারছেন না। দ্রুত সময়ে সেবা দেওয়া ও আসামি ধরতে গিয়েও পড়ছেন বিপাকে। যার অন্যতম কারণ দায়িত্বপূর্ণ এলাকার সম্পর্কে পূর্ব ধারনা ও রাস্তাঘাট চেনা না থাকা।
ডিএমপি সূত্রে জানা গেছে, ৫০ থানাসহ ডিএমপির বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত ১৬ হাজারেও বেশি পুলিশ সদস্য ও কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। যাদের মধ্যে অধিকাংশই ইতোমধ্যে নতুন কর্মস্থলে যোগ দিয়েছেন।
দীর্ঘদিন দেশের বিভিন্ন জেলা ও প্রত্যন্ত থানা এলাকায় কাজ করে বদলি হয়ে ডিএমপিতে আসা বেশ কয়েক জন উপ-পরিদর্শকদের (এসআই) সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রত্যন্ত এলাকার থানা ও ডিএমপির থানা এলাকার অপরাধের ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। ডিএমপিতে ১২ ঘণ্টা ডিউটির পাশাপাশি অন্যান্য রুটিন কাজ করতে হয়। ফলে শুরুতেই এতো কাজের চাপে অল্পতেই খেই হারাচ্ছেন মাঠে কাজ করা এসআই ও পরিদর্শকরা। ডিএমপিতে ঘটে যাওয়া অপরাধে জড়িতদের চিহ্নিত করতে তথ্য প্রযুক্তির পাশাপাশি মাঠ পর্যায়ের সোর্স একটি শক্তি। কিন্তু হঠাৎ করে ডিএমপিতে আসা বেশিরভাগ এসআইয়ের স্থানীয় সোর্স নেই। কোনো ঘটনা ঘটলে তদন্ত করতে গিয়ে তারা সামনে এগুতে পারছেন না। বাধ্য হয়ে বিগত সময়ে ডিএমপিতে কাজ করা পরিচিত ব্যাচমেট ও সহকর্মীদের সহযোগিতা চাইতে হচ্ছে।
ডিএমপিতে নিজের কাজের অভিজ্ঞতার বিষয় এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলেছেন বেশ কয়েকজন এসআই। তাদের মধ্যে একজন তার প্রায় ১২ বছরের বছরের চাকরি জীবনে প্রথমবার ডিএমপিতে বদলি হয়ে এসেছেন। এর আগে নির্দিষ্ট একটি জেলায় কাজ করেছেন প্রায় ৮ বছর। নাম-পরিচয় গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, ডিএমপিতে বেশি দিন কাজ করবো না। পোস্টিং দিয়েছে তাই আসলাম। এখানে প্রচুর কাজের চাপ। হঠাৎ করে পরিবার থেকে দূরে একা হয়ে যাওয়া পাশাপাশি দিনরাত কাজের চাপে মাত্র এক মাসেই হাঁপিয়ে ওঠেছি। আমরা এতো কাজে অভ্যস্ত না। ১২ ঘণ্টা গাড়িতে টহল দিয়ে আবার মামলার তদন্তের কাজ করা। আগে সারাদিন কাজ করলেও চাকরি মনে হতো না। আর এখন দায়িত্বটাকে বোঝা মনে হচ্ছে।
মাঠের কাজের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, আমি যে জেলা কাজ করেছি সেখানে কোনো অপরাধ ঘটলে তার আসামি ধরতে সময় লাগতো না। আর এখন আমি তো রাস্তাই চিনি না। আসামি ধরবো কীভাবে। আসামি তো আর মেইন রাস্তায় থাকে না। ঢাকা শহরের সব অলিগলিই তো আমার কাছে একই মনে হয়। এখানে তো আমি কাউরে চিনিই না। অপরাধ ঘটলে শনাক্ত করবো কীভাবে? শহরের মানুষ পুলিশকে এখন ভয় পায় না। উল্টো আমরা ভয়ে থাকি কে কখন কী অভিযোগ দিয়ে দেয়।
৫ আগস্ট রাজধানীর অন্তত ২২টি থানায় হামলা ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। থানার গুরুত্বপূর্ণ নথিসহ খোয়া গেছে বহু অস্ত্র। ডিএমপির সদর দফতরের সেপ্টেম্বর মাসের অভিযানের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, সরকারের বেঁধে দেওয়া সময়ের পরে গত অক্টোবরে বিভিন্ন মডেলের ৩৫টি অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে। যার বেশিরভাগ আবার যৌথ বাহিনী উদ্ধার করেছে। একই সময়ে দুই হাজারেরও বেশি গুলি উদ্ধার হয়েছে। এছাড়াও গ্রেনেড ও অস্ত্রের ম্যাগাজিনও উদ্ধার করা হয়েছে।
ঢাকায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ২৮৪টি। এর মধ্যে বর্তমান ও সাবেক শতাধিক পুলিশ সদস্যের নাম রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, আন্দোলনে গুলি চালিয়ে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড হিসেবে কাজ করেছেন শতাধিক পুলিশ সদস্য। অনেকে আটকও হয়েছেন।
পুলিশ সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে ডিএমপির সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে, ৩৮টি। এর পরের অবস্থানে রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে ৩৬টি। সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা ৩৩, ডিএমপি যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকারের বিরুদ্ধে ২৭, স্পেশাল ব্রাঞ্চের প্রধান মনিরুল ইসলামের বিরুদ্ধে ১১। মামলাগুলোর মধ্যে অধিকাংশই হত্যা মামলা। মামলায় নাম রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার, সহকারী পুলিশ কমিশনার, একাধিক থানার ওসি, ইন্সপেক্টর, এসআই ও কনস্টেবলদেরও। সর্বোচ্চ মামলা হয়েছে যাত্রাবাড়ী থানায় ৯১টি।
৫ আগস্টের পর ডিএমপির ৫০ থানায় বিভিন্ন ঘটনায় ২ হাজার ৩৭টি মামলা দায়ের হয়েছে। যার মধ্যে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনে ছাত্রজনতার নিহতের ঘটনাসহ ২৮৬টি হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে। তবে এই সকল মামলায় কতজন গ্রেফতার হয়েছে সেই তথ্য পাওয়া যায়নি।
ডিএমপি পুলিশের গণহারে বদলি ও ঢাকায় নতুন আসা মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, জুলাই বিপ্লবের পরে আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক করার প্রশ্নে সাধার মানুষের প্রত্যাশার একটি চাপ পুলিশের ওপর রয়েছে। পুলিশের বদলি নতুন কিছু না। তবে অন্যান্য বড় শহরের মতো ঢাকাও অপরাধের অরণ্য। ফলে প্রশাসনের নতুন পুরাতনদের মিশ্রণের সমন্বয় করা। সবাইকে নতুন নিয়ে আসলে তাদের বাস্তবতা বুঝে ওঠতে ওঠতে অনেক সময় লেগে যাবে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণ সমন্বয় করে করতে হয়। এটা কোনো কর্মকর্তার একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। ঢাকার বাইরে থেকে নতুনদের না এনে যাদের বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ নেই তাদের, যারা নৈতিকতা বজায় রেখেছেন তাদের রেখে কাজ করতে হবে। আর না হলে নতুনরা পুরাতন হতে হতে অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠবে।
পুলিশের ওপর সাধারণ মানুষের সেবা প্রত্যাশা ও ডিএমপির কাজে যোগ্য করে তোলার করণীয় সম্পর্কে এই অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলেন, মানুষের সেবা প্রত্যাশা পূরণে নতুন সদস্যদের অভ্যন্তরীণভাবে মনস্তাত্ত্বিক সাহস বাড়ানো, মাঠের কর্মকর্তাদের সমস্যাগুলো শোনা, কাউন্সিলিং করা, কী ব্যবস্থা নিলে কাজে গতি আসবে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে হবে। আমাদের দেশের পুলিশের ভেতরে আলোচনার অভ্যাস নেই।
পুলিশের সবচেয়ে বড় এ ইউনিটের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে করণীয় জানতে চাইলে ডিএমপির সাবেক কমিশনার ও সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি খন্দকার গোলাম ফারুক বার্তা২৪.কমকে বলেন, এতো বড় একটি গণবিপ্লব হওয়ার পরে কিছুদিন সকল সেক্টরেই একটি সমস্যা হয়। এটা ঠিক হতে সময় লাগবে। ডিএমপিতে আগে যারা ছিল তারাও তো নতুন ছিল। এখন যারা আসছে তারাও দ্রুত সময়ের মধ্যেই রাস্তাঘাট চেনাসহ সমস্যা কাটিয়ে ওঠবেন।
অতিরিক্ত ডিউটি তাদের মানসিক চাপ সৃষ্টি করছে, এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে কি না জানতে চাইলে ডিএমপির ৩৫ তম এ কমিশনার বলেন, বর্তমানে যারা ডিএমপি চালাচ্ছেন তারা প্রয়োজন মনে করলে মানসিক কাউন্সিলিংয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।