৬ হাজার কোটির বিনিয়োগে

মেট্রোরেলের থেকে ৮ গুণ বেশি যাত্রী টানবে বাস

  • রাজু আহম্মেদ ,স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

রাজধানী ঢাকা। ১ হাজার ৪৬৩ বর্গকিলোমিটারের এই শহরে বসবাস করে অন্তত ২ কোটিরও বেশি মানুষ। বিপুলসংখ্যক এই জনগোষ্ঠীর বিপরীতে সব মিলে রোড নেটওয়ার্ক ৩ হাজার কিলোমিটার। ফলে সব সময় সড়ক সক্ষমতার বাইরে থাকবে শহর এটাই স্বাভাবিক। তবে স্বাভাবিকের মাঝেও কিছু অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া প্রতিনিয়ত ভোগাচ্ছে বিপুল সংখ্যক এসব মানুষকে। সড়কের নৈরাজ্য এক প্রকার মেরুদণ্ড বাঁকা করেছে রাজধানীর। সঙ্গে নিরাপদ পরিবহণ ব্যবস্থা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে কোটি কোটি মানুষ।

সড়কের সক্ষমতার বাইরে যাওয়া ঢাকা শহরে নামে বে-নামে অন্তত ৫০টির অধিক মালিকানার প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বাস চলাচল করে। কোন নিয়মনীতি তো দূরের কথা সড়কের আইন মানারও কোন বালাই নেই এসব যানবাহনের। এক কথায় 'জোর যার মুল্লুক তার' প্রবাদটির কার্যকরী চিত্র রাজধানীর সড়কে বাসের এমন চলাচল। ঢাকার সড়কে নিজের ইচ্ছে মত বাস চালিয়ে প্রবাদটিকে পূর্ণতা দেওয়া এসব যানবাহন বছরের পর বছর ভোগালেও, সড়কে জিগজ্যাগ নিয়মে চলাচলের হেরফের হয়নি বছরের পর বছর। একাধিক কোম্পানি ও মালিকানার বাস থাকায় নানা উদ্যোগেও সড়কে নৈরাজ্যে শৃঙ্খলায় ফেরানো যায়নি বিগত দুই দশকের বেশি সময়ে।

বিজ্ঞাপন

গবেষকরা বলছেন, সড়কের এমন নৈরাজ্যের পিছনে ব্যাপক দুর্বলতা আছে কর্তৃপক্ষের। তেমনি কোনো পরিকল্পনা না করেই রাজনৈতিক বিবেচনায় বিভিন্ন কূটকৌশলে দেওয়া হয়েছে বাসের রুট। ফলে সড়ক সক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সড়কের ন্যূনতম বিজ্ঞান ভিত্তিক পরিকল্পনার ধারের কাছেও নেই বাংলাদেশ।

https://imaginary.barta24.com/resize?width=700&quality=100&type=webp&path=uploads/news/2024/Nov/14/1731582711876.jpg

বিজ্ঞাপন

বিষয়টি আরও স্পষ্ট করে বলছেন বুয়েট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. হাদিউজ্জামান। তার মতে ঢাকার মত মেগাসিটিতে নেই ফরমাল গণপরিবহন। ঢাকায় চলাচল করা সিটি বাসগুলোকে গণপরিবহন বললেও এসব বাস গণপরিবহনের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না।

ড. হাদিউজ্জামান বার্তা২৪.কমকে বলেন, গণপরিবহন হতে হলে এটার একটা সময় সূচি থাকতে হবে। একটা ফ্রিকুয়েন্সিতে আসতে হবে। প্রতি পাঁচ মিনিট বা প্রতি ১০ মিনিটে। তবে ঢাকার এসব বাস গণপরিবহনের সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। বিগত কয়েক যুগ ধরে বাসের যে অনুমোদনগুলো দেওয়া হয়েছে, রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি বা আরটিসি আছে যারা অনুমোদন দিয়েছে। তাদের এখানে ব্যাপক দুর্বলতা ছিল। এদের তো শুধু অনুমোদন দিলেই হবে না। বাসগুলোর জন্য অবকাঠামো লাগে। বাস স্টপেজ, টিকেট কাউন্টার প্রয়োজন। দিন শেষে বাসগুলো ডিপোতে যাবে। তবে এসব বিবেচনা না করে শুধু মাত্র রাজনৈতিক বিবেচনায় বাসের রুট পারমিট দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক ক্ষমতা খাটিয়ে একই রুটগুলোকে একটু সামনে পিছনে করে আরেকটা রুট নাম দিয়ে, সেখানে আরও বাস ঢুকানো হয়েছে। ফলে একই রুটে অসংখ্য বাস চলে আসছে। এতে সেবা খাত হিসেবে যেভাবে প্ল্যানিং থাকার কথা তার ধারে কাছে আমরা নেই। বিজ্ঞান থেকে যোজন যোজন দূরে আমরা চলে গেছি।

এখন প্রশ্ন হলো ঢাকার সড়কের গতি ফেরাতে এমন অবস্থার সমাধান কোথায়? 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজধানীতে কোম্পানি লিস্টেট বাস সার্ভিসে ঘুঁচবে পথ। বড় বিনিয়োগ না করে ৬ হাজার কোটি টাকায় মেট্রোরেলের চেয়ে বেশি আদর্শিক পরিবহণ ব্যবস্থা আনা সম্ভব। এতে রাজধানীর ৭০ শতাংশ যানজট কমবে। রাজধানীতে চলাচল করা সাড়ে ৩ লক্ষ ব্যক্তিগত গাড়িও আসবে নিয়ন্ত্রণে। এতে যেমন সড়কে শৃঙ্খলা ফিরবে অন্য দিকে ডাবল ক্যাপাসিটি সেবাও নিশ্চিত হবে।


এ বিষয়ে ড. হাদিউজ্জামান বলেন, আমি মনে করি এখন আমরা যেহেতু একটি পরিবর্তনের কথা বলছি, একটা সুযোগ এসেছে। আসলে আমাদের একটা গভর্নমেন্ট লিস্টেট কোম্পানি করে বাসগুলোকে আওতায় নেওয়া উচিত। বাসগুলো ব্যক্তি মালিকানায় এভাবে বিক্ষিপ্তভাবে চলতে থাকলে শৃঙ্খলায় আনা বা ফিটনেস বিহীন, রুট পারমিট বিহীন, লক্করজ-ঝক্কর যে বাসগুলো আছে তা সরানো সম্ভব হবে না। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নাই। ফলে কোম্পানির আওতায় আনা হলে যে বাসগুলোর ইকোনমিক লাইভ শেষ, এসব রুট থেকে সরিয়ে নিতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে সরকার এবং যারা শেয়ার হোল্ডার থাকবে তারা বিনিয়োগ করবে। ধীরে ধীরে নতুন নতুন বাস আসবে। তখন দেখা যাবে যে বাসগুলোর মানও ভালো হবে।

তিনি আরও বলেন, প্রয়োজন বোধে আমরা অপারেশনাল একটা চমৎকার প্ল্যান করতে পারি।

গণপরিবহন আসলে শহরের মেরুদণ্ড হয়। বাসগুলো আমরা আলাদা লেনে নিয়ে আসতে পারি। সিগনালে গিয়ে আমরা তাকে প্রায়োরিটি দিতে পারি। তখন ব্যক্তিগত গাড়ির যাত্রীরা বসে দেখবে আমার পাশ দিয়ে গণপরিবহনটা চলে গেলো। সময় সাশ্রয়ীর সঙ্গে ভালো মানের বাস এখানে নামানো সম্ভব। এয়ার কন্ডিশন হবে। লো ফ্লর হবে। ডাবল ডোর হবে লন্ডনের মত বাস এখানে আনা সম্ভব। তখন ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহারকারীরা বাসের প্রতি আগ্রহী হবে। এসব না করে ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে আনার ওষুধ কাজ করবে না।

এই গবেষক আরও বলেন, ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা গেলে পুরো ঢাকা শহরের চমৎকার গণপরিবহন তৈরি করা সম্ভব। ২০২৭ সালে গিয়ে ৩টা মেট্রোরেল করা হবে। সেখানে প্রায় আড়াই লক্ষ কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। অথচ আমরা গবেষণা করে দেখেছি, যদি ৬ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়, তাহলে মেট্রোরেলের থেকে আটগুণ যাত্রী বাসে পরিবহণ করা সম্ভব।


এদিকে দীর্ঘদিন পরে হলেও এবার সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে কোম্পানি লিস্টেট বাসের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী ৩ মাসে যার রূপরেখা পূর্ণতা দেওয়ার ইচ্ছা সিটি কর্পোরেশন ও ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের।

এ বিষয়ে ঢাকা পরিবহণ সমন্বয় কর্তৃপক্ষের নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, আমরা কোম্পানি ভিত্তিক বাস পরিচালনার কথাই ভাবছি। এবং প্রধানত যে যে রুটে বাস অপারেট করছে, তারা যাতে সেটি করতে পারে সে দিকটা আমরা জোর দিব।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রশাসক মো. নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের সাথে বাস মালিক সমিতি ও শ্রমিকদের প্রতিনিধিরা সহযোগিতা করবেন। তারা আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। আমরাও একমত হয়েছি আমরা পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থায় একটি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনব। গণপরিবহনের আওতায় আসার জন্য অ্যাপ্লিকেশন আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত আমরা অ্যাপ্লিকেশনগুলো নিব। কোম্পানির মাধ্যমে রুট ফিক্সড করা হবে। কোম্পানির আওতায় আমরা গাড়ি পরিচালনা করব। নগর পরিবহণ নাম থাকলেও এখানে মালিকানায় থাকবে কোম্পানি।