হজ লাইসেন্স নিয়ে ফারুকীর অভিনব প্রতারণা

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

হজ লাইসেন্স নিয়ে ফারুকীর অভিনব প্রতারণা, ছবি: বার্তা২৪.কম

হজ লাইসেন্স নিয়ে ফারুকীর অভিনব প্রতারণা, ছবি: বার্তা২৪.কম

সরল বিশ্বাসে নিজের হজ লাইসেন্স ব্যবসায়িক চুক্তির আওতায় লুৎফুর রহমান ফারুকী নামের একজনকে দিয়ে নানাবিধ হয়রানি, বদনাম ও মামলার শিকার হয়েছেন গ্র্যান্ড সিকদার এয়ার ট্রাভেলসের মালিক মো. নাসির উদ্দিন সিকদার।

জানা গেছে, নাসির উদ্দিন সিকদারের মালিকাধীন হজ এজেন্সির বিপরীতে হজযাত্রী নিবন্ধনের টাকা দেখিয়ে পাঁচ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ নিয়ে তা পরিশোধ না করে তালবাহানা করছেন লুৎফুর রহমান ফারুকী।

বিজ্ঞাপন

এ বিষয়ে প্রতারণার শিকার মো. নাসির উদ্দিন সিকদার বার্তা২৪.কমকে বলেন, ‘আমি সরল বিশ্বাস লুৎফুর রহমান ফারুকীকে লাইসেন্স পরিচালনার জন্য দিয়ে বিপদের শিকার, তার কূটচালে সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছি; আমার ব্যবসায়িক সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে।’

তিনি জানান, ফারুকীর কারণে আমার গ্র্যান্ড সিকদার এয়ার ট্রাভেলসের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকায় এখনও বৈধ তালিকায় নাম আসেনি। ফলে হজযাত্রী নিবন্ধন করতে পারছি না। এটা নিয়ে ধর্ম মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে ঘুরেও কোনো প্রতিকার মেলেনি। উল্টো ব্যাংক কর্তৃপক্ষ পাঁচ কোটি টাকা ঋণ আদায়ের জন্য আমার নামে মামলা করেছেন।

বিজ্ঞাপন

গ্র্যান্ড সিকদার এয়ার ট্রাভেলস (হজ লাইসেন্স নং-৯২৯) হজ ও উমরা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা অনুযায়ী ২০২৩ সালের ৭ মার্চ গাজীপুর এয়ার ট্রাভেলস (হজ লাইসেন্স নং-৭৮২)-এর মালিক লুৎফুর রহমান ফারুকীর সঙ্গে হজ এজেন্সি নিবন্ধন সনদ হস্তান্তরের আদলে একটি ব্যবসায়িক চুক্তি করেন। চুক্তির শর্তানুযায়ী গ্র্যান্ড সিকদার এয়ার ট্রাভেলসের নামে প্রিমিয়ার ব্যাংক মহাখালী শাখায় একটি ব্যাংক হিসাব খোলা হয়। হিসাবটি হজকালীন সময়ে পরিচালনার জন্য লুৎফুর রহমান ফারুকীকে অথরাইজড করা হয়। পরে লুৎফুর রহমান ওই হজ লাইসেন্সের বিপরীতে প্রিমিয়ার ব্যাংক মহাখালী শাখা থেকে পাঁচ কোটি টাকার একটি মূলধন ঋণ নেন। ওই ঋণের টাকায় ৪৪৮ জন হজযাত্রীর মূল রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের নিদের্শনানুযায়ী ফ্লাইট ভাড়া বাবদ গ্র্যান্ড সিকদার এয়ার ট্রাভেলসের ব্যাংক হিসাবে লিয়েন করে রাখা হয়।

হজ লাইসেন্সের বিপরীতে ঋণগ্রহণের কথা জেনে নাসির উদ্দিন সিকদার ব্যাংকে চিঠি দিয়ে লুৎফুর রহমান ফারুকীর হিসাব পরিচালনার ক্ষমতা প্রত্যাহার ও ব্যাংক হিসাব স্থগিত করার অনুরোধ করেন। অন্যদিকে হজযাত্রীদের বিপরীতে ব্যাংক ঋণের জটিলতা নিরসন না করে লুৎফুর রহমান ফারুকী রেজিস্ট্রেনকৃত ৪৪৮ জন হজযাত্রীকে আল রিসান ট্রাভেলস (হজ লাইসেন্স নং ৬৭২) স্থানান্তর করা হয়। এই লাইসেন্সটিও লুৎফুর রহমান ফারুকী অন্যের কাছ থেকে ব্যবসায়িকভাবে পরিচালনার জন্য গ্রহণ করেছেন।

এভাবে মূল এজেন্সির মালিকের অনুমতি ছাড়া স্থানান্তরের ফলে ৪৪৮ হজযাত্রীর উড়োজাহাজ ভাড়া পরিশোধের বিষয়টি আরও জটিল হয়। এটা নিয়ে পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হয়। এমনকি লুৎফুর রহমান ফারুকীর হজ রেজিস্ট্রেশন, হজযাত্রী স্থানান্তর, হজযাত্রীর উড়োজাহাজ ভাড়া সংক্রান্ত নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির কথা, হজযাত্রীদের বাংলাদেশে রেখে সৌদি আরবে চলে যাওয়া, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের একাধিক চিঠি এবং হজ কার্যক্রমে তাকে নিষিদ্ধ করার কথা গণমাধ্যমে মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়।

মক্কা হজ মিশনের সামনে মিছিল করছেন হাজিরা, ছবি: সংগৃহীত

এ সময় লুৎফুর রহমান ফারুকী আমাকে ম্যাসেজ দিয়ে বলেন, ‘নাসির ভাই, আমি মহাবিপদে পড়ে গেছি, ভিসা করতে দেরি হওয়ার কারণে নিউজ হয়ে যাওয়ায় হাজিরা ঠিকমত টাকা দিচ্ছে না। তাছাড়া মোয়াল্লেমরা অফারে অগ্রিম টাকা দিতে চেয়েছিল তাও দিচ্ছে না। তাই হাজিগুলো পাঠানোর ব্যাপারে বিরোধিতা না করে সহযোগিতা করেন। লোন পরিশোধের তো এখনো সময় আছে, হজের পরে ব্যবসা চালু থাকলে এগুলো নিয়ে বাঁধবে না। চিন্তা করবেন না, আপনাকে বিপদে ফেলব না- ইনশাআল্লাহ। বিপদের সময় আমাকে সাহায্য করেন, আমি আপনাকে সহযোগিতা করব- ইনশাল্লাহ। ব্যাংকের টাকা মেরে দেওয়ার প্রশ্নই আসে না, তবে পরিশোধ করতে একটু সময় লাগতে পারে। চিন্তা করবেন না।’

এদিকে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ হাব (হজ এজেন্সি এসোসিয়েশন বাংলাদেশ) নেতা এবং ধর্ম মন্ত্রণালয়ের চাপে প্রকৃত হজযাত্রীর নিকট থেকে উড়োজাহাজ ভাড়া ব্যাংক হিসাবে জমা না করে ব্যাংকের লোনের টাকা হজের টাকা হিসেবে দেখিয়ে লিয়েনকৃত অর্থ লিয়েন সম্বনয় না করে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ছাড় করে দেয়। তখন হজ ফ্লাইট শেষের দিকে, আমারও কোনো কিছু করার থাকে না। কিন্তু আমি আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হই।

মো. নাসির উদ্দিন সিকদার আরও বলেন, লুৎফুর রহমান ফারুকীর সঙ্গে ব্যবসায়িক চুক্তিনুসারে পাঁচ কোটি টাকার চেক শুধুমাত্র জামানত হিসাবে ব্যবহৃত হবে উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও তার প্ররোচণায় ব্যাংক চাপের মুখে টাকা ট্রান্সফার করে। ফলে পুরো ঋণের দায়ভায় আমার ওপর এসে বর্তায়। অথচ গ্র্যান্ড সিকদার এয়ার ট্রাভেলসের নামে ৪৪৮ জন রেজিস্ট্রেশন হজযাত্রী নিবন্ধন হলেও আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো হজযাত্রীর টাকা গ্রহণ করি নাই। আমার কাছে মন্ত্রণালয়ের চিঠি থেকে শুরু করে সব কাগজ রয়েছে, কবে কোথায় কীভাবে টাকা ট্রান্সফার হয়েছে, সব ডকুমেন্ট থাকার পরও আমার নামে মামলা করা হয়েছে। আমি এর প্রতিকার চাই।

এ বিষয়ে জানতে লুৎফুর রহমান ফারুকীকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি। তবে হাবের একাধিক সাবেক নেতা নাম প্রকাশ না করে বার্তা২৪.কমকে জানিয়েছেন, ‘প্রতিবারই হজ মৌসুমে হাজিদের সঙ্গে নতুন নতুন ঘটনা নিয়ে আলোচনায় আসেন লুৎফুর রহমান ফারুকী। বিভিন্নজনের কাছ থেকে লাইসেন্স ভাড়া নিয়ে একেক বছর একেক লাইসেন্স নিয়ে নানা অপকর্ম করেন। তার পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক হজ লাইসেন্স রয়েছে, তিনি সেগুলো ব্যবহার করেন না। হজ নিয়ে নানা অনিয়মের কারণে লুৎফুর রহমান ফারুকী একাধিকবার গ্রেফতার হন, তারপরও থামেনি তার অপতৎপরতা।’

হজযাত্রীদের সঙ্গে বিভিন্ন সময় প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাৎ, জালিয়াতি, নানাবিধ গাফিলতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনাসহ নানা কারণে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয় মুফতি লুৎফুর রহমান ফারুকীকে হজ কার্যক্রমে নিষিদ্ধ করেছে। প্রতারণার দায়ে হজ-উমরার কার্যক্রমে কাউকে নিষিদ্ধ করার ঘটনা এটাই প্রথম।

চলতি বছরের ৬ জুন ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের হজ অধিশাখা থেকে যুগ্মসচিব ড. মো: মঞ্জুরুল হক সাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে সুষ্ঠু হজ ব্যবস্থাপনার স্বার্থে লুৎফুর রহমান ফারুকীর সঙ্গে হজ ও উমরা বিষয়ে কোনো ধরনের আর্থিক লেনদেন না করার জন্যও সর্বসাধারণের প্রতিও অনুরোধ জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, লুৎফুর রহমান ফারুকীকে ভবিষ্যতে সব ধরনের হজ ও উমরা কার্যক্রমে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলো। একই সঙ্গে ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধিত কোনো হজ এজেন্সি তার সংঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হজ কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করলে সেই এজেন্সির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে লুৎফুর রহমান ফারুকী মক্কা হজ মিশনের সামনে হজের পর হাজিদের দিয়ে মিছিল করায়। ওই ঘটনায় সৌদি আরবের কাছে বাংলাদেশকে জবাবদিহি করতে হয়। দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরে দেশে ফিরে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে একটি রীট করেন লুৎফুর রহমান ফারুকী। সেটি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি।