সিন্ডিকেটের চক্রান্তে বন্ধ ‘চট্টলা চাকা’ এসি বাস, যাত্রীদের ক্ষোভ
অক্সিজেন-ফটিকছড়ি রুটে ২০২২ সালের ২৩ মে চট্টগ্রাম নগরী থেকে যাত্রা শুরু করা শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস ‘চট্টলা চাকা’ যাত্রীবান্ধব সেবার কারণে বেশ প্রশংসিত ছিল। তবে বাস মালিকদের একটি সিন্ডিকেটের প্রভাবে ৬ ডিসেম্বর এই জনপ্রিয় বাস সার্ভিসটি বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রতিবাদ জানিয়ে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে বাস সার্ভিসটি পুনরায় চালু করার দাবি জানান যাত্রীরা।
‘চট্টলা চাকা’ বন্ধ হওয়ার পেছনে অভিযোগ, অন্যান্য বাস সার্ভিসগুলোর নিম্নমানের সেবা ও যাত্রীদের হয়রানির কারণে যাত্রীরা উন্নত সেবার জন্য ‘চট্টলা চাকা’ বেছে নিয়েছিলেন। তবে এর ফলে কম যাত্রীর কারণে ক্ষতির মুখে পড়েন অন্যান্য বাস মালিকরা। এরপরই একটি সিন্ডিকেট বাস সার্ভিসটি বন্ধ করার জন্য চাপ তৈরি করে।
গেল দুই বছর শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ‘চট্টলা চাকা’ বাস সেবা চালু ছিল, তবে ৫ আগস্টের পর সিন্ডিকেটটি প্রশাসনিক নিষ্ক্রিয়তার সুযোগ নিয়ে বাস বন্ধ করতে তৎপর হয়ে ওঠে। সেসব বাস মালিকরা হুমকি দিয়ে ‘চট্টলা চাকা’ কর্তৃপক্ষকে চাপ দেয়, যার ফলে এক মাসের বেশি সময় সার্ভিসটি বন্ধ রাখা হয়। ১০ সেপ্টেম্বর নাজিরহাট বাস মালিক সমিতি ও ফটিকছড়ি উপজেলা প্রশাসনের সহায়তায় বাসটি পুনরায় চলতে শুরু করে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেল ১৭ নভেম্বর 'চট্টলা চাকা' বাস সার্ভিসটি বন্ধ করতে নাজিরহাট বাস মালিক সমিতির কাছে একটি চিঠি লিখেন ওই সিন্ডিকেটের কয়েকজন। আটজন বাস মালিকের স্বাক্ষর করা ওই চিঠিতে 'চট্টলা চাকা'র কারণে বাস মালিকদের 'বিভিন্ন ধরনের ক্ষতি হবে' বলে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে বাস সার্ভিসটি বন্ধ রাখতে 'চট্টলা চাকা' কর্তৃপক্ষকে নানাভাবে হুমকি-ধমকি দিতে থাকে ওই সিন্ডিকেট। এর প্রেক্ষিতে নানামুখী চাপে বাধ্য হয়ে ওই বাস সার্ভিসটি বন্ধ করে দেয় 'চট্টলা চাকা' কর্তৃপক্ষ।
এই রুটে নিয়মিত চলাচল করেন মো. জাহাঙ্গীর আলম। তিনি বলেন, অক্সিজেন-ফটিকছড়ি রুটের বাসগুলো যাত্রীদের জিম্মি করে রেখেছিল, যাত্রী হয়রানি ও অতিরিক্ত ভাড়ার কারণে ‘চট্টলা চাকা’ আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে এখন সার্ভিস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় আবার আগের মতো ভোগান্তিতে পড়তে হবে।
এই বিষয়ে 'চট্টলা চাকা'র নির্বাহী পরিচালক মো, শাহজাহান বলেন, ওদের হুমকি-ধমকির কারণে বাস বন্ধ করতে হয়েছে। চট্টলা চাকা বাস বন্ধ না করলে মালিক সমিতির কার্যালয়ে তালা দেবে বলে হুমকি দিয়েছে। তাছাড়া ৫ আগস্টের পর গাড়িতে হামলা করেছে একাধিকবার, কয়েকজন চালককেও মারধর করেছে। এরমধ্যে একটি কাউন্টারে আগুনও লাগিয়ে দিয়েছিল। তারা ৭০ টাকা ভাড়া নেয়, আমরা ১০০ টাকা নিই। কিন্তু তাদের দাবি আমাদের ১৬০ টাকা ভাড়া নির্ধারণ করতে হবে। কিন্তু আমরা কেন এত বেশি ভাড়া নির্ধারণ করে যাত্রীদের পকেট কাটতে যাব?
নাজিরহাট বাস মালিক সমিতির কাছে লেখা চিঠিতে যে আট জন বাস মালিকের স্বাক্ষর রয়েছে তাদের দু'জনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের একজন মো. রিদোয়ান বলেন, এক রুটে একাধিক সার্ভিস চলাচল করতে পারে না। তাছাড়া ওটা যেহেতু এসি বাস সার্ভিস, তাই আমরা বলেছি যেন ভাড়া ১৬০ টাকা করে নেয়। কিন্তু ওরা ভাড়া নির্ধারণ করেছে ১০০ টাকা, এতে আমাদের সাধারণ মালিকদের সমস্যা হচ্ছে। অন্যজন মো. আমান উল্লাহ বলেন, ওরা লোকাল গাড়ির পারমিট নিয়ে এসি বাস চালাচ্ছে। কিন্তু এটা আলাদা পারমিটে চলতে পারবে, পারমিটটা আমাদের দেখাতে হবে। তাদের কারণে সাধারণ বাস মালিকদের ক্ষতি হচ্ছে। আর আমি বন্ধ করার কেউ না, আমি তাদের বাস বন্ধ করিনি। আমরা মালিক সমিতিকে জানিয়েছি শুধু।
এছাড়া, বাস মালিকদের অভিযোগ ছিল যে ‘চট্টলা চাকা’ এসি বাসের কারণে তাদের যাত্রী সংখ্যা কমে যাচ্ছে এবং তাই ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছিল।
নাজিরহাট বাস মালিক সমিতির সভাপতি ইদ্রীস মিয়া বলেন, এসি বাস চলাচলের কারণে নাকি লোকাল বাসের মালিকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাদের যাত্রী কমে গেছে। 'চট্টলা চাকা' নিয়ে যাত্রীরা সন্তুষ্ট ছিল। কম সময়ে গন্তব্যে পৌঁছতে পারলে, ভালো সেবা পেলে সবাই পছন্দ করবে, এটাই স্বাভাবিক। এই কারণে 'চট্টলা চাকা'তে যাত্রী বেশি হয়। এখন কয়েকজন মালিক এই বাস সার্ভিসটি বন্ধ করে দেওয়ার জন্য আবেদন করেছে। তবে বাসগুলো যেহেতু বিলাসবহুল, তাই কোনো ক্ষয়ক্ষতি যেন না হয় সেজন্য আপাতত বন্ধ রাখছে কর্তৃপক্ষ।
যাত্রীবান্ধব সেবাগুলো রক্ষায় সরকারি তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোকে দায়িত্ব নিতে হবে জানিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যারা সর্বোত্তম সেবা দেয়, যেসব সার্ভিসকে যাত্রীবান্ধব পরিবহন বলে মনে করেন যাত্রীরা, তাদের টিকিয়ে রাখা সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব। কিন্তু বিআরটিএ বা ট্রাফিকে যাত্রীদের কোনো প্রতিনিধি না থাকায় এটা হয়ে উঠে না। এই কারণে যাত্রীবান্ধব উদ্যোগগুলো নানামুখী চাপে মুখ থুবড়ে পড়ছে।