সাগরে গ্যাস অনুসন্ধানে দরদাতা না পাওয়ার কারণ জানতে কমিটি
সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে দরপত্র কিনলেও জমা না দেওয়ার কারণ জানতে কমিটি গঠন করেছে পেট্রোবাংলা। পরিচালককে (পিএসসি) প্রধান করে গঠিত কমিটিকে এক মাসের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার।
বাংলাদেশের সমুদ্র অঞ্চলে ২৪টি ব্লকে (গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ৯টি) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের দরপত্র আহ্বান করা হয় চলতি বছরের ১১ মার্চ। দরপত্র জমার জন্য ৬ মাস (৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) সময় দেওয়া হয়। সময় শেষ হওয়ার আগেই কেউ কেউ ৬ মাস পর্যন্ত সময় চাইলেও ৩ মাস বাড়িয়ে ৯ ডিসেম্বর করা হয়। মার্কিন কোম্পানি এক্সোন মবিলসহ ৭টি আন্তর্জাতিক খ্যাতনামা কোম্পানি দরপত্র কিনেছিল, ২টি কোম্পানি পেট্রোবাংলা থেকে ডাটা কিনেছিল। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কেউই দরপত্র জমা দেয়নি।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, ৭টি কোম্পানি দরপত্র কিনলেও কেন জমা করলো না তার কারণ জানতে কমিটি করা হয়েছে। দরপত্র আহ্বানের পর সভা, সেমিনার ও বৈঠক হয়েছে, সেখানে কোম্পানিগুলোর পক্ষ থেকে যেসব বিষয় সামনে এসেছিল সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হবে। আবার আমাদের মডেল পিএসসিতে (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি) কোনো সমস্যা আছে কি-না সেগুলোও যাচাই করবে কমিটি। প্রয়োজনে তারা কনসালটেন্টের (উড ম্যাকেঞ্জি) সঙ্গে কথা বলবে। উড ম্যাকেঞ্জি আমাদের পিএসসি প্রণয়নের পরামর্শক ছিলেন।
কমিটির রিপোর্ট পাওয়ার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। যদি রি-টেন্ডার করার সুযোগ থাকে তাহলে রি-টেন্ডার করা হবে। আর যদি পিএসসি রিভিউ করতে হয়, তাহলে সেভাবে প্রস্তাবনা প্রেরণ করা হবে।
কেন দরপত্র জমা দেয়নি এর কোনো কারণ জানা গেছে কি? এমন প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, কোনো কোম্পানি সেভাবে কিছু জানায়নি, তবে কেউ কেউ ধারণা করছে গ্যাসের দরের বিষয়টি এখানে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। গ্যাসের দর ক্রড অয়েলের দামের সঙ্গে উঠানামা করার শর্ত রয়েছে। বর্তমানে ক্রড অয়েলের দাম ৭২ ডলারের মতো, এটা কারণ হলেও হতে পারে।
সাগর সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চলের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশের। বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রে ১৫টি এবং অগভীর সমুদ্রে ১১টি ব্লক আছে। অগভীর সমুদ্রের দুটি ব্লকে অনুসন্ধান পরিচালনা করছে ভারতের কোম্পানি ওএনজিসি। এর আগে সর্বশেষ ২০১৬ সালে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালে নতুন পিএসসি আপডেট করা হলেও দরপত্র ডাকা হয়নি।
২০১০ সালে গভীর সমুদ্রে ডিএস-১০ ও ডিএস-১১ ব্লকে কাজ নেয় কনোকো ফিলিপস। তারা ২টি জরিপ শেষে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দাবি করে। সেই দাবি পূরণ না হওয়ায় কাজ ছেড়ে চলে যায়। এছাড়া চুক্তির পর কাজ ছেড়ে চলে যায় অস্ট্রেলিয়ান কোম্পানি স্যান্তোস ও দক্ষিণ কোরিয়ার পস্কো দাইয়ু। বাংলাদেশের পাশের ব্লক থেকে দীর্ঘদিন ধরে গ্যাস উত্তোলন করছে মায়ানমার। যে কারণে বাংলাদেশ অংশে গ্যাস পাওয়ার বিষয়টি অনেকটা নিশ্চিত বলে ধারণা করা হয়। বাংলাদেশের সাগরাঞ্চলে গ্যাসের মজুদের বিষয়ে আশাবাদী জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করছে দেশের গ্যাস সংকট কাটাতে বিশাল ভূমিকা পালন করতে পারে।
এক প্রশ্নের জবাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান বলেন, গ্যাসের অবস্থান নিয়ে কোনো সংশয় নেই, কোনো কোম্পানি এমন তথ্য জানায়নি। গ্যাস রয়েছে এটা অনেকটা নিশ্চিত। আমরা মাল্টিক্লায়েন্ট সার্ভের ডাটাও হাতে পেয়েছি, সেগুলোও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে।
বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করে তোলার জন্য আকর্ষণীয় করা হয় পিএসসিকে (উৎপাদন ও বন্টন চুক্তি)। আগের পিএসসিগুলোতে গ্যাসের দর স্থির করা দেওয়া হলেও এবার ব্রেন্ট ক্রডের দরের সঙ্গে মিল করে দেওয়া হয়। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রডের ১০ শতাংশ দরের সমান। যা আগের পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল।
দামের পাশাপাশি বাংলাদেশের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। মডেল পিএসসি-২০১৯ অনুযায়ী গ্যাসের উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে বাংলাদেশের অনুপাত বৃদ্ধি পেতে থাকবে। আর কমতে থাকে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ার। গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের হিস্যা ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত উঠানামা করবে। কিন্তু তারপরও কোনো আগ্রহী প্রতিষ্ঠান না পাওয়াটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের চলমান গ্যাস সংকট ও উৎপাদনরত খনিগুলোর মজুদ কমিয়ে আসাটা বেশি করে ভাবাচ্ছে।
মডেল পিএসসি ২০০৮ প্রণয়ন কমিটির প্রধান মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেন, অনেকে মনে করেছিলেন গ্যাসের দাম বাড়ালেই কোম্পানিগুলো দৌড়ে আসবে। সেই ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কেন জমা হয়নি সেটা তালাশ করার পাশাপাশি কেন মাত্র ৭টি কোম্পানি দরপত্র কিনেছে সেটাই দেখা দরকার। পিএসসিতে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে, এখানে শর্ত দেওয়া হয়েছে দৈনিক ২০ হাজার ব্যারেল (তেলের সমান) গ্যাস উত্তোলন করে এমন কোম্পানি দরপত্র কিনতে পারবে। এখানেইতো অনেক কোম্পানি বাদ পড়ে গেছে। আমি মনে করি গভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ১০ হাজার এবং অগভীর সমুদ্রের ক্ষেত্রে ৫ হাজার ব্যারেল হওয়া উচিত। তাহলে আরও অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিতে পারবে।
তিনি বলেন, আমরা যখন ২০০৮ সালে পিএসসি প্রণয়ন করি তখন ১৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দিতে চেয়েছিলাম। একটি বিদেশি কোম্পানি এসে আমাদের বললো ২৫ হাজার ব্যারেল শর্ত দেওয়ার জন্য। আমরা রাজি না হলেও মন্ত্রণালয় থেকে ২৫ হাজার করা হয়েছিল। আরেকটি অন্যতম কারণ হচ্ছে ডাটা প্যাকেজের দাম অনেক বেশি। কোনো কোনো প্যাকেজের দাম মিলিয়ন ডলারের মতো। অন্য দেশে এসব ডাটা ফ্রি দেয়। ১৯৭৪ সালে আমাদের দেশে এসব ডাটা উন্মুক্ত ছিলো, তখন অনেক বেশি কোম্পানি অংশ নিয়েছিলো।
এছাড়া রাজনৈতিক পরিস্থিতিটা অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে, বড় কোম্পানিরা সার্বিক বিষয়ে বিশ্লেষণ করে বিনিয়োগ করার আগে বলে মন্তব্য করেন তিনি।