দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন বাংলাদেশ বিনির্মাণের আহ্বান টিআইবির
কর্তৃত্ববাদী শক্তির পরাজয়ের মধ্য দিয়ে একটি সুশাসিত, অসাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যমুক্ত স্বদেশ বিনির্মাণের যে সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে, সেই সুযোগকে বাস্তবে রূপ দিতে সরকার, রাজনৈতিক দল, জনসাধারণ ও তরুণ প্রজন্ম, বিশেষ করে শিক্ষার্থীসহ সকলের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবার ভিত্তিতে জড়িত টিআইবি সদস্যগণ।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) বিভিন্ন শ্রেণি ও পেশার সদস্যের অংশগ্রহণে ধানমন্ডিস্থ কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত টিআইবির বার্ষিক সভায় এ আহ্বান জানানো হয়।
সভায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যে সকল শিক্ষার্থী-জনতা নিহত ও আহত হয়েছেন, দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন সেই সকল ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নিরপেক্ষ ও স্বাধীন তদন্তের মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সকল ঘটনার জবাবদিহি ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিতেরও জোর দাবি জানিয়েছেন টিআইবি সদস্যবৃন্দ।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানের সঞ্চালনায় সভায় সভাপতিত্ব করেন টিআইবি সদস্য মোহাম্মদ ইলিয়াস খান।
সভায় উপস্থাপিত সদস্যগণ টিআইবি পরিচালিত গবেষণা, অধিপরামর্শমূলক ও প্রচারণাসহ বিভিন্ন কার্যক্রম এবং সংশ্লিষ্ট আর্থিক হিসাবের সর্বোচ্চ মানসম্পন্ন নিরীক্ষা প্রতিবেদন সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য এবং সার্বিক কার্যক্রমের বিষয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।
সভা শেষে এক ঘোষণাপত্রে বলা হয়, দেশের স্বাধিকার থেকে শুরু করে সর্বশেষ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র দেশ যেভাবে একসঙ্গে লড়েছে, একটি সুশাসিত ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সেই বন্ধন যেন সুদৃঢ় ও অটুট থাকে, সেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন। একইসঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে ধর্মীয় ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব অনাকাঙ্ক্ষিত হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষীদের শাস্তি নিশ্চিতের দাবি জানায় সদস্যবৃন্দ।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, চরম স্বেচ্ছাচারী শাসন কাঠামোতে সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ঘাটতিতে দুর্নীতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছিল। দুদকসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার কারণে দুর্নীতির সিন্ডিকেট এতটাই শক্তিশালী যে, সাধারণ জনগণ জিম্মি হয়ে দুর্নীতিকে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এরকম বাস্তবতায়, সম্প্রতি দুদকে নতুন চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ প্রদান করা হয়েছে। তাই শুধু নেতৃত্বের পরিবর্তন নয়, বরং প্রতিষ্ঠানটিকে জনবান্ধব ও দুর্নীতিমুক্ত করার জন্য সম্পূর্ণরূপে ঢেলে সাজাতে হবে।
টিআইবির সদস্যগণ মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হলো, কর্তৃত্ববাদের বিদায়ের মধ্য দিয়ে জনমনে মুক্ত গণমাধ্যম এবং স্বাধীন ও অসংকোচ মত প্রকাশের যে প্রত্যাশার সঞ্চার হয়েছে, তা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সকলেই যাতে চিন্তা, বিবেক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার চর্চা করতে পারে, তার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ। বিগত কর্তৃত্ববাদী শাসন কাঠামোর ন্যায় স্বাধীন মত ও সাংবাদিকতার কারণে কেউ যেন হয়রানি, দোসর আখ্যায়িত বা ট্যাগিং এর শিকার না হয়, সে ব্যাপারে সকলকে উদার ও সহিষ্ণু আচরণ করার আহ্বান জানান তারা।
একইসঙ্গে ভিন্নমত দমন ও গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের সিদ্ধান্ত জনমনে যে স্বস্তির সঞ্চার করেছিল, সেখানে পর্যাপ্ত বিশ্লেষণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক পর্যালোচনা ব্যতিরেকে ‘সাইবার সুরক্ষা অধ্যাদেশ ২০২৪’ জারির উদ্যোগ এটির অপব্যবহার হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে বলে ঘোষণাপত্রে জানানো হয়। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের মতামত প্রদানের পর্যাপ্ত সুযোগ ও তাদের সুপারিশের আলোকে অধ্যাদেশটি জারি এবং গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট সকল আইন, নীতি ও বিধিমালা যথাযথ পর্যালোচনা সাপেক্ষে সংশোধন এবং নতুন সমন্বিত গণমাধ্যম আইন প্রণয়ন করতে কর্তৃপক্ষের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান টিআইবির সদস্যগণ।
ঘোষণাপত্রে আরও বলা হয়, কাঙ্ক্ষিত বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ খাতসমূহ সংস্কারের উদ্দেশ্যে ১১টি কমিশন গঠন করেছে। তবে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা চিরস্থায়ী করণের অপপ্রয়াস থেকে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি, বহুমুখী দুর্বৃত্তায়ন ও বিচারহীনতার সংস্কৃতির যেভাবে বিস্তার ঘটানো হয়েছে, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে সকল সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের স্বাধীনভাবে কাজ করার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করাসহ এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধান ও সদস্যদের নিয়োগে দলীয়করণ বন্ধ করতে সুনির্দিষ্ট যোগ্যতা ও অযোগ্যতার শর্ত অন্তর্ভুক্ত ও প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংস্কার করতে হবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও মর্যাদা রক্ষায় বিচার বিভাগের পরিপূর্ণ ক্ষমতায়িত নিজস্ব সচিবালয় স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে যুগোপযোগী শৃঙ্খলা ও আচরণ বিধিমালা প্রণয়ন করার পরামর্শ দেন টিআইবি সদস্যগণ।
আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানবাধিকার রক্ষায় সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ঢেলে সাজাতে হবে। সর্বোপরি তারা সার্বিক সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি সুস্পষ্ট রোডম্যাপ প্রণয়ন করার আহ্বান জানান, যাতে করে পরবর্তী সময়েও সংস্কার কার্যক্রম স্তিমিত হয়ে না পড়ে এবং এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলসমূহকেও অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
মহান ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনাকে ধারণ করে সততা, মূল্যবোধ, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা, ন্যায্যতা, জবাবদিহি চর্চার মাধ্যমে সকল প্রকার শোষণ ও বৈষম্য অবসানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষকে গণতন্ত্র, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে সভা শেষ হয়।