গ্রেগরীয় বা খ্রিস্টীয় নতুন বছরকে 'ইংরেজি নববর্ষ' হিসেবে উল্লেখ করছে অনেক বাংলাদেশি টিভি চ্যানেল, গণমাধ্যম ও ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ ব্যবহারকারী! এটি ভুল। কেননা কেবল ইংরেজি মাতৃভাষার মানুষ 'ইংরেজ'দের অথবা ইংল্যান্ড রাজ্যের বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন নয় ১ জানুয়ারি।
সে কারণে, ১ জানুয়ারি ইংরেজি নববর্ষ নয়। এটি গ্রেগরীয় বা খ্রিস্টীয় নববর্ষ। গ্রেগরীয় বা খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জির প্রথম দিন।
বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ও বিশ্বজুড়ে সর্বাধিক প্রচলিত বর্ষপঞ্জি এই গ্রেগরীয় ক্যালেন্ডার। এটি খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের ধর্মগুরু পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরী প্রবর্তিত একটি সৌর বর্ষপঞ্জি। যা গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি (Gregorian Calendar) নামে পরিচিত।
গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির প্রবর্তন হয় ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে। ইতালিতে।
এর আগে প্রবর্তিত ছিল জুলীয় বর্ষপঞ্জি বা জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি। রোম সম্রাট জুলিয়াস সিজার মিশর বিজয়ের পর ৪৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে সৌরবর্ষ ভিত্তিক জুলিয়ান বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন।
জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির গণনা অনুসারে একটি মহাবিষুব থেকে আরেকটি মহাবিষুব পর্যন্ত সময়কাল ধরা হয়েছিল ৩৬৫.২৫ দিন, যা প্রকৃত সময়কাল থেকে প্রায় ১১ সেকেন্ড কম।
এই ১১ সেকেন্ডের পার্থক্যের ফলে প্রতি ৪০০ বছর অন্তর মূল ঋতু থেকে জুলিয়ান বর্ষপঞ্জির প্রায় তিন দিনের ব্যবধান ঘটত।
পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরির সময়ে এই ব্যবধান ক্রমশ বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ১০ দিনের এবং ফলস্বরূপ মহাবিষুব ২১ মার্চের পরিবর্তে ১১ মার্চ পড়েছিল।
এই বর্ষপঞ্জি মূলতঃ ইতালি সহ ইউরোপে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীরা অনুসরণ করতে শুরু করে।
১৭৫২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের অনুসারী যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন এবং যুক্তরাষ্ট্র এই বর্ষপঞ্জি গ্রহণ করে। তখন তাদের বর্ষপঞ্জি থেকে ১১ দিন বাদ দেয়। সেকারণে ১৭৫২ সালের পঞ্জিকায় ৩ সেপ্টেম্বর থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর এই ১১ টি দিন পাওয়া যায় না।
পরবর্তীকালে ব্রিটেন, স্পেন, ফ্রান্স, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ডস, বেলজিয়াম, ইতালি ও জার্মানি সহ ইউরোপের দেশগুলোর সকল উপনিবেশে এই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি প্রবর্তিত হয়।
ফলে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের দেশগুলোও এই গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির আওতায় আসে।
ভারতীয় উপমহাদেশে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির আগমন ঘটে ইউরোপ থেকে ভারতে আগত পর্তুগীজ, ফরাসী ও ব্রিটিশ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে।
প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান বাংলাদেশ ও অবিভক্ত বাংলা বা বঙ্গ সহ সমগ্র ভারতবর্ষে অনেক ধরনের বর্ষপঞ্জি প্রচলিত ছিল।
এর মধ্যে কিছু ছিল পৃথিবীকে চাঁদের আবর্তনকে ভিত্তি করে ৩৫৪ দিনের চান্দ্রবর্ষ এবং আর কিছু ছিল সূর্যকে পৃথিবীর আবর্তনকে ভিত্তি করে ৩৬৫ দিনের সৌরবর্ষ।
ভারতে শাসকদের রাজ্যভিত্তিক বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হতো। তবে উত্তর ভারতে 'বিক্রম সংবৎ' বা বিক্রমী বর্ষপঞ্জি এবং মধ্য ও দক্ষিণ ভারতে 'শালিবাহন শক সংবত' অনুসারে শক বর্ষপঞ্জি বা শকাব্দ সবচেয়ে বেশি প্রচলিত ছিল।
তবে দ্বাদশ শতাব্দীতে, সুনির্দিষ্টভাবে ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে, দিল্লি মুসলমান শাসনের অধীনে আসার পর সুলতানী রাজত্বে চান্দ্রবর্ষ ভিত্তিক আরবী হিজরী ও ফার্সি জালালি বর্ষপঞ্জির প্রবর্তন হয়।
ইরানের ইসফাহান রাজ্যে ১০৭৯ খ্রিস্টাব্দে সূচিত জালালি বর্ষপঞ্জি আট শতাব্দী পরে সৌরবর্ষ অনুসরণ করে। ইরান ও আফগানিস্তানে আজও জালালি বর্ষপঞ্জির বিভিন্ন রূপ প্রচলিত রয়েছে।
ভারতে ১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে মুঘল শাসনামলের সূচনায় চান্দ্রবর্ষ ভিত্তিক আরবী হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয়। তবে তা' সৌরবর্ষের চেয়ে ১১ দিন ছোট হওয়ায় কৃষিভিত্তিক ভারতে বার্ষিক খাজনা আদায়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসুবিধার সৃষ্টি করে।
কৃষিভিত্তিক ভারতে ফসল তোলার মওসুমের সাথে বার্ষিক খাজনা আদায়কে সাযুজ্যপূর্ণ করতে মুঘল সম্রাট আকবর চান্দ্রবর্ষ ভিত্তিক হিজরী বর্ষপঞ্জিকে সংস্কার করে সৌরবর্ষ ভিত্তিক এক বর্ষপঞ্জি প্রবর্তন করেন। যার ভিত্তি বর্ষ ধরা হয় ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ। কেননা সেই বছরে হিজরী সাল ছিল ৯৬৩ এবং বাংলা সালও ছিল ৯৬৩ বঙ্গাব্দ।
মুঘল সম্রাট আকবর প্রবর্তিত এই বর্ষপঞ্জি বঙ্গ সংবৎ থেকে উদ্ভূত বঙ্গাব্দের সংস্কারকৃত রূপ বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দ হিসেবে পরিচিত।
১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর মাধ্যমে ভারতে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে সিপাহী বিদ্রোহের পরের বছর ব্রিটিশ রাজতন্ত্র ভারতকে উপনিবেশ হিসেবে শাসনভার গ্রহণ করে। এর পরই এই উপমহাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি চালু করা হয় বলে ধারণা করা হয়।
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পর পূর্ব বাংলা সহ পাকিস্তানে রাষ্ট্রীয়ভাবে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জি এবং ধর্মীয় কাজে হিজরী বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয়।
বাংলাদেশে ১৯৮৭ খ্রিস্টাব্দে গ্রেগরীয় বর্ষপঞ্জির সাথে সাযুজ্য রেখে ১৪ এপ্রিলকে বঙ্গাব্দের প্রথম দিন ১ বৈশাখ নির্ধারণ করে সংস্কারকৃত সৌরবর্ষ ভিত্তিক বাংলা বর্ষপঞ্জি বা বঙ্গাব্দকে এদেশের জাতীয় বর্ষপঞ্জি হিসেবে গ্রহণ করা হয়।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরা রাজ্যে এবং বাঙালি হিন্দুরা যে বঙ্গাব্দ প্রচলিত তা' সৌরচান্দ্রবর্ষ ভিত্তিক। বাংলাদেশের জাতীয় বর্ষপঞ্জি বঙ্গাব্দের সাথে ভারতের বঙ্গাব্দের পার্থক্য এক দিনের।
বর্তমানে ভারতে চার ধরনের বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয়: ১. গ্রেগরীয় বা খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি; ২. শালিবাহন পঞ্জিকা অনুসারে সৌরবর্ষ ভিত্তিক সংস্কারকৃত ভারতীয় জাতীয় বর্ষপঞ্জি শক বর্ষপঞ্জি, ৩. বিক্রম বর্ষপঞ্জি; ও ৪. হিজরী বর্ষপঞ্জি। ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে স্থানীয়ভিত্তিক বর্ষপঞ্জি চালু রয়েছে।
আর বর্তমানে বাংলাদেশে তিন ধরনের বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হয়: ১. সৌরবর্ষ ভিত্তিক সংস্কারকৃত জাতীয় বর্ষপঞ্জি বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন; ২. সৌরবর্ষ ভিত্তিক গ্রেগরীয় বা খ্রিস্টীয় বর্ষপঞ্জি খ্রিস্টাব্দ; এবং ৩. চান্দ্রবর্ষ ভিত্তিক আরবী বর্ষপঞ্জি হিজরী সাল।