ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ আবদুস সালাম। শহীদ আবদুস সালামের গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার লক্ষ্মণপুর (বর্তমানে সালামনগর) গ্রামে। গ্রামটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হওয়ায় সারা বছর কেউ এখানে আসেন না। শুধুমাত্র একুশে ফেব্রুয়ারি এলেই মানুষের আনাগোনা বাড়ে এ গ্রামে অন্যথায় বছরের অন্যান্য সময় থাকে নিষ্প্রাণ। অন্যদিকে ফেনীর ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছে বাড়িটির গ্রন্থাগারের আসবাবপত্র।
ভাষা শহীদ সালামের স্মরণে সালামনগরে তৈরি করা হয়েছে সালাম স্মৃতি জাদুঘর। ২১ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে নানা কর্মযজ্ঞে প্রাণ ফিরে আসে ‘ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে’। ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু হয় গ্রন্থাগার ও জাদুঘর পরিষ্কার ও সাজসজ্জার কাজ। শহীদ দিবস উপলক্ষ্যে সালামনগরে শহীদ সালামের গ্রামের বাড়িতে শ্রদ্ধা জানিয়ে আলোচনা সভা করেছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, গেল বছরের আগস্টে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর পানিতে তলিয়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যায় বই, তাকসহ গুরুত্বপূর্ণ আসবাবপত্র। পর্যাপ্ত বুক শেলফ না থাকায় অনেকগুলো বই টেবিলে স্তূপ করে রাখা হয়েছে। প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়ায় সেখানে পাঠকের তেমন আনাগোনা নেই বললেই চলে। আবার দীর্ঘসময় ধরে নেই নতুন কোনো বইও। এ ছাড়া জাদুঘরে শহীদ সালামের একটি ছবি ছাড়া আর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই।
জানা গেছে, ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই গ্রামের নাম সালাম নগর করা হয়। প্রায় ৬৪ লাখ টাকা ব্যয়ে শহীদ সালামের বাড়ির অদূরে নির্মাণ করা হয় ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। ২০০৮ সালের ২৬ মে স্মৃতি জাদুঘর ও গ্রন্থাগারটি আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ।
অন্যদিকে, লক্ষ্মণপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তন করে ভাষা শহীদ আব্দুস সালাম সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় করা হয়েছে এবং ভাষা শহীদ সালামনগর গ্রামে বেসরকারিভাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ভাষা শহীদ সালাম মেমোরিয়াল কলেজ ।তবে ভাষা শহীদ সালামের বাড়ি ফেনী জেলা সকলে জানলেও ঠিক ভাবে জানে না ফেনীর কোথায় তার ঠিকানা। যার কারণে সালামের স্মরণে তৈরি জাদুঘর, পাঠাগার রয়েছে জনশূণ্য।
এলাকার বাসিন্দারা জানায়, ২১শে ফেব্রুয়ারি ঘিরেই সালামনগরে গুরুত্ব বেড়ে যায়। বছরের অন্য দিনগুলোতে মানুষের তেমন আনাগোনা থাকেই না। এছাড়াও পাঠাগারে পাঠকের দেখা নেই বললেই চলে বলে জানান তারা।
ভাষা শহিদ আবদুস সালামের বাড়ির পাশের প্রতিবেশী রেদওয়ান কবির বলেন, স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কয়েক বছরে এলাকার রাস্তাঘাটসহ অবকাঠামোগত কিছু উন্নয়ন হলেও বন্যায় আবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিভিন্ন উন্নয়ন হলেও স্মৃতি জাদুঘরে শহিদ সালামের একটি ছবি ছাড়া আর কিছুই নেই। ফলে, দর্শনার্থীরা হতাশ হয়ে ফিরে যান। গ্রন্থাগারে কিছু বই রয়েছে, তবে সেগুলো অনেক পুরাতন। নতুন নতুন বই দিয়ে আশপাশের স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের সপ্তাহে এক দিন গ্রন্থাগারটি পরিদর্শনে আনা গেলে শহীদ সালাম সম্পর্কে তরুণ প্রজন্ম আরও বেশি জানতে পারবে।
আরিফ আজিজ নামের আরেক বাসিন্দা বলেন, সংশ্লিষ্ট বিভাগ যদি এ স্থানটি আরও জনসম্পৃক্ত করতে উদ্যোগ নেয় তাহলে শহীদের আত্মত্যাগ সমুন্নত হবে। অন্যান্যবার কিছু আলোকসজ্জা থাকলেও এবার একুশের প্রথম প্রহরে এখানে মোবাইলের লাইট দিয়ে পুষ্পমাল্য অর্পণ করা হয়েছে। এমন অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতা আমাদের জন্য লজ্জার।
আবদুল্লাহ আল মামুন নামে আরেকজন বলেন,শহীদ দিবসে মানুষের আনাগোনা থাকে শুধু এছাড়া সারাবছর পাঠাগার ও জাদুঘরটি থাকে জনশূণ্য। তিনি জানায়, প্রত্যন্ত অঞ্চল হওয়াতে ও প্রচার-প্রচারণার অভাবে সাধারণ মানুষের তেমন আনাগোনা নেই।
রফিক নামে এক স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, গ্রন্থাগারটি চেনার কোনো উপায় নেই। ফেনী-নোয়াখালী আঞ্চলিক মহাসড়কে যদি একটি তোরণ নির্মাণ করা হয় তাহলে মানুষ ভাষা শহীদ আব্দুস সালামের গ্রামের বাড়ি সহজে চিনতে পারবে। এছাড়া সড়ক সংস্কার, সড়কবাতি লাগানোসহ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরের প্রাণ ফেরানো সম্ভব।
ফেনী শহরে ভাষা শহীদ সালাম স্টেডিয়ামের নামে একটি স্টেডিয়াম ও একটি কমিউনিটি সেন্টারের নামকরণ করা হয়। স্টেডিয়াম ও কমিউনিটি সেন্টার থাকলেও সালামের নামে ফেনীতে নেই কোনো গ্রন্থাগার, নেই কোনো গবেষণাগার ও বিনোদন কেন্দ্র। ফেনীতে সালামের নামে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গ্রন্থাগার, গবেষণাগার ও বিনোদন কেন্দ্র থাকলে মানুষ ভাষা শহীদ সালামকে স্মরণে রাখতে পারবে এবং শহীদ সালাম সর্ম্পকে জানতে পারবে বলে জানিয়েছে ফেনীর সুশীল সমাজ।
ইমন আহম্মেদ নামের এক যুবক জানায়, ফেনীর মতো জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে ভাষা শহীদ সালামের নামে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলে বা বিনোদন কেন্দ্র স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে ব্যাপক সাড়া পাবে। ফেনীতে দেশের ৬৪ জেলা থেকে মানুষ আসে নানা কাজে ফলে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ছুটে আসা সাধারণ মানুষ ফেনী জেলার এই ভাষা শহীদ সম্পর্কে অনেকে জানবে ও শিখবে।
মাসুম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, বইতে ভাষা শহীদ রফিক, জব্বার, বরকতের পাশাপাশি সালামের নাম জেনেছি এবং জেনেছি আমাদের ফেনীতে উনার নিজ জেলা। ফেনী জেলা হলেও ফেনীতে তেমন কিছু নেই উনাকে স্মরণে রাখার মতো।
ভাষা শহীদ আবদুস সালাম গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিক লুৎফুর রহমান বাবলু বলেন, বন্যার সময় বই ও তাক পানিতে ডুবে এখানকার জিনিসপত্র নষ্ট হয়ে যায়। তখন রোদে শুকিয়ে বইগুলো কিছুটা পাঠযোগ্য করা গেলেও তাক নষ্ট হওয়ায় অগোছালোভাবে পড়ে আছে।
শহীদ আবদুস সালামের ছোট ভাই সুবেদার (অব.) আবদুল করিম বলেন,ফেব্রুয়ারি মাস এলেই সবাই আমাদের খোঁজখবর নেন। বর্তমানে আমি অসুস্থ। এ পরিবার থেকে আমার মেয়ে খাদিজাকে একটি সরকারি চাকরি দেওয়ার জন্য প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি। কিন্তু কারও কাছ থেকেই কার্যকর সহযোগিতা না পাওয়ায় তা বাস্তবায়ন হয়নি।
দাগনভূঞা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) স ম আজহারুল ইসলাম বলেন, পাঠাগারে কিছু সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে। এজন্য ইতোমধ্যে জেলা পরিষদে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। বরাদ্দ পেলে সেখানকার ফার্নিচার, বইসহ প্রয়োজনীয় সংস্কার কাজ করা হবে।
উল্লেখ্য, ভাষা শহীদ আবদুস সালামের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের লক্ষণপুর গ্রামে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনের রাস্তায় ১৪৪ ধারা অগ্রাহ্য করে ছাত্র-জনতা বাংলা ভাষার দাবিতে মিছিল করেন। আবদুস সালাম সেই মিছিলে অংশ নেন। মিছিলে পুলিশ গুলি চালালে আবদুস সালাম আহত হন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় প্রায় দেড় মাস পর ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল মারা যান তিনি। পরে তার নামানুসারে লক্ষণপুর গ্রামের নাম রাখা হয় ‘সালামনগর’।