‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের একমাত্র দাবিদার মওলানা ভাসানী’
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর আদর্শে ২০১১ সালে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনকে চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম বাবলুকে মহাসচিব করে ভাসানী অনুসারী পরিষদের আত্মপ্রকাশ ঘটে। আব্দুল মতিন পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার পর ডা. জাফরুল্লাহ নিজ ইচ্ছায় এ সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন। দীর্ঘ ১২ বছর তিনি এ দায়িত্ব পালন করেন। তার মৃত্যুর পর বর্তমানে আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করছেন রফিকুল ইসলাম বাবলু। বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে দীর্ঘদিনের সঙ্গী গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরীক দলও ভাসানী অনুসারী পরিষদ। মওলানা ভাসানীর আদর্শের বাস্তবায়ন ও আগামীর রাজনীতি নিয়ে বার্তা২৪.কম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন স্টাফ রিপোর্টার মো. নজরুল ইসলাম।
বার্তা২৪.কম: ভাসানী অনুসারী পরিষদ গঠনের লক্ষ্য কী?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: আদর্শিক রাজনীতি বিশ্বাস করি বিধায় আমি মওলানা ভাসানীর আদর্শের অনুসারী। তার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আন্দোলন করেছি, ভবিষ্যতেও করবো। তার আদর্শিক রাজনীতিটা মানুষের সামনে তুলে ধরবো। মওলানা ভাসানী কোন ধরনের বাংলাদেশ চেয়েছিলেন-সেটা আমরা মানুষের সামনে আমরা তুলে ধরবো। তার আদর্শ বাস্তবায়ন করার জন্য আমাদের দলের মূল স্লোগান মওলানা ভাসানীর আদর্শ প্রতিষ্ঠায় আমরা অঙ্গিকারবদ্ধ। আমরা আশাবাদী মওলানা ভাসানীর আদর্শ বাস্তবায়নের যে কর্মসূচি তা মানুষ গ্রহণ করবে।
বার্তা২৪.কম: মওলানা ভাসানীর রাজনীতিতে কিভাবে আসলেন?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান আন্দোলনের সময় থেকে আমি মওলানা ভাসানীর সঙ্গে রয়েছি। জামালপুরে কলেজে পড়াকালীন বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন করেছি। পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলাম। ৯০ পরবর্তী সময়ে বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙ্গে গেলেও আমরা মওলানা ভাসানীর মৃত্যুবার্ষিকী, জন্মবার্ষিকী, লংমার্চ দিবস পালন করেছি। পরবর্তীতে ২০১১ সালে ভাষা সৈনিক আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে আমি মহাসচিব হিসেবে ভাসানী অনুসারী পরিষদের আত্মপ্রকাশ করি। ২০২২ সালের ৮ই আগস্ট জেএসডি, নাগরিক ঐক্য, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ ও রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চ নামের একটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম গঠিত হয়েছে।
বার্তা২৪.কম: মওলানা ভাসানী সম্পর্কে আপনার কাছে জানতে চাই।
রফিকুল ইসলাম বাবলু: মওলানা ভাসানী সম্পর্কে স্বল্প সময়ে বলে শেষ করা যাবে না। তবুও আপনাকে বলি- আজীবন উনি ছিলেন মজলুমের বন্ধু, সাম্রাজ্যবাদ, আধিপত্যবাদ এবং অত্যাচারী শাসক ও শোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এক আপোষহীন যোদ্ধা। তিনি সারা জীবন অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন, সংগ্রাম করেছেন। মওলানা ভাসানী না আসলে বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না। তার জন্যই বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়েছে। ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে একপাশে শেখ মুজিব একপাশে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী ও মাঝখানে উনি সভাপতিত্বের ভাষণে তিনি পাকিস্তানিদের ওয়ালাইকুম আসসালাম বলে দিলেন। ওইদিনই বাংলাদেশের ভিত্তি রচনা হয়েছিল। তারপরের ইতিহাস সবার জানা ৫৭, ৬২ এর ছাত্র আন্দোলন, ৬৪, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনও তার নেতৃত্বে হয়েছে। ৫৪ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন হক-ভাসানীর কথা আপনারা সবাই জানেন। সে সময় মুসলিম লীগের কবর রচনা করেছিলেন তারা। ৬৯-এ গণঅভ্যুত্থানটা যদি উনি না ঘটাতেন তাহলে শেখ মুজিব হতে পারতেন না, তাকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলতে হতো।
ইতিহাসের চাকা বারবার সামনের দিকেই ঘুরে। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের একমাত্র দাবিদার মওলানা ভাসানী। ভাসানীর ইতিহাস আপন মোহনায় মানুষের সামনে চলে এসেছে। আওয়ামী লীগ মাওলানা ভাসানীর ইতিহাস মুছে ফেলার বহু ষড়যন্ত্র করেছে। তারা পারেনি ভবিষ্যতেও পারবে না।
বার্তা২৪.কম: আপনি কোন আসন থেকে নির্বাচন করতে চান?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: আমরা যেহেতু রাজনীতি করি, রাজনীতি করি বিধায় ক্ষমতার আকঙ্খা অবশ্যই আছে। আর ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র পথ হচ্ছে নির্বাচন। সেই নির্বাচন আমরা অবশ্যই ফেস করবো। নির্বাচনের মাধ্যমেই আমাদের আদর্শ, কর্মসূচি জনগণের সামনে তুলে ধরবো। জনগণ আমাদের গ্রহণ করলে আমরা জনপ্রতিনিধি হবো। আমার নির্বাচনী এলাকা জামালপুর সদর-৫। এই আসনেই নির্বাচন করবো এটা আমার দলের সিদ্ধান্ত।
বার্ত২৪.কম: অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কী কী সফলতা ও ব্যর্থতা রয়েছে বলে আপনি মনে করেন?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: একটা ভঙ্গুর অবস্থায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন, এটাই দেশের জন্য অনেক পাওয়া। কারণ এ দেশ থেকে কোটি কোটি, বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাচার হয়ে গেছে। একটা ভঙ্গুর অর্থনীতির দেশে যে রিস্কটা তিনি নিয়েছেন আমি মনে করি বাংলাদেশের জন্য এটাই সফলতা। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি একটা বড় কাজে হাত দিয়েছেন তা হলো সংস্কার। গত ৫৩ বছর যেভাবে দেশ চলছে এভাবে চলতে পারে না। কাজেই একটা সংস্কার দরকার। তিনি আমাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই সংস্কার কাজে হাত দিয়েছেন। এই সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারলে দেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়ে যাবে।
সরকারের কিছু ব্যর্থতা যদি বলা হয় তাহলে প্রশাসনসহ সব জায়গায় যেভাবে দলীয়করণ করা হয়েছিল. এখানে সবাই আওয়ামী লীগ। এ কারণে পুলিশসহ অন্যান্য শৃঙ্খলা বাহিনী সঠিকভাবে কাজ করতে পারেনি।
বার্তা২৪.কম: সংস্কার নাকি নির্বাচন? কোনটা জরুরি বলে মনে করেন?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: আমি মনে করি সংস্কার ও নির্বাচন দুটোরই প্রয়োজন আছে। প্রয়োজনীয় সংস্কার দ্রুত শেষ যাওয়া উচিত। সংস্কার শেষ করে নির্বাচনের দিকে যাওয়ায় শ্রেয়। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংস্কার করতে পারবে তবে মেন্ডেট জনগণের কাছেই নিতে হবে।
বার্তা২৪.কম: ৭২-এর সংবিধান বাতিলের দাবি উঠছে। এ বিষয়ে কী বলবেন?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: একটা সংবিধানের আন্ডারে দাঁড়িয়ে থেকে কিভাবে তারা সংবিধান বাতিল চায়। এদেরকে এ ব্যাপারে আরো একটু সতর্ক থাকতে হবে। যেহেতু তারা একটা নেতৃত্ব দিয়েছে এদেরকে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। তবে একটা সংবিধান থাকতে আরেকটা সংবিধান আসতে পারে না। এই বাতিল তারা ৬ তারিখে চাইতে পারতো তারা সেটা না করে পাঁচ মাস পরে এসে একটা সংবিধানের অধীনে শপথ নিয়ে এটা করতে পারে না।
বার্তা২৪.কম: পরবর্তী জাতীয় সংসদ কখন হতে পারে?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: এটার টাইম ঠিক করবে প্রধান নির্বাচন কমিশন বা যারা সরকারে রয়েছে তারা। তবে আমার মনে হয় ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নির্বাচন হয়ে যাবে।
বার্তা২৪.কম: সংসদ নির্বাচেনে বিএনপির সঙ্গে জোট করলে কতটি আসন চাইবেন?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: ছয়টি ছয়টি দলের জোট গণতন্ত্র মঞ্চ। এটি আবার বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের শরিক। ২০১৬ সাল থেকে আমরা বিএনপির সঙ্গে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের এই গণঅভ্যুত্থান। এই আন্দোলনে গণতন্ত্র মঞ্চের অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে। জোটগত নির্বাচন বা এককভাবে নির্বাচনের কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। তবে জোটে গেলে সেখানে আমার দলের ১৫ থেকে ২০ জন থাকবে বলে আশা করি।
বার্তা২৪.কম: আওয়ামী লীগের ফিরে আসাকে কিভাবে দেখছেন?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: আওয়ামী লীগ আর এ দেশে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে না। শেখ মুজিবকে আমি যথেষ্ট শ্রদ্ধা করি। এদেশের প্রতিষ্ঠায় মওলানা ভাসানীর সঙ্গে থেকে তিনি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন। কিন্তু উনি এসে ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত যে রাজত্বটি করেছেন। গণহত্যার রাজনীতি করে তিনি ৩২ হাজার রাজনীতিবিদ হত্যা করেছেন, তার মেয়ে ক্ষমতায় এসে ২ হাজার মানুষ মারলেন। তাই রাজনৈতিক দল হিসেবে যদি পুনরায় জগণের সামনে আসে তাহলে জনগণ তাদেরকে আর গ্রহণ করবে না।
বার্তা২৪.কম: আগামী রাজনীতি একাত্তরের চেতনায় হবে ওপর নাকি চব্বিশ?
রফিকুল ইসলাম বাবলু: ৭১-কে কোনো দিনই বাদ দেওয়া যাবে না। ৭১ ছিল আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা অর্জন হয়েছে। এটাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নাই। এটাকে যদি কেউ খাটো করে দেখতে যায় তারা কখনই দাঁড়াতে পারবে না। একাত্তরের পরে ৯০ এর আন্দোলনে ফ্যাসিবাদ এরশাদের পতন ঘটেছে, এরপর এই ২৪ এর আন্দোলন। চব্বিশের আন্দোলন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু একাত্তরের অবস্থানটা অনেক উপরে।