পার্বত্য শান্তিচুক্তির ২৭ বছরেও শান্তি ফেরেনি পাহাড়ে। এখনও পড়ছে লাশ, ঝড়ছে রক্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়িতে সড়ক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও মানুষের নিরাপত্তা ও আর্থসামাজিক উন্নয়নে তেমন পরিবর্তন আসেনি।
পাহাড়ে বারবার রক্ত ঝরার নেপথ্যে রয়েছে ৬টি সশস্ত্র সংগঠনের মধ্যে দ্বন্দ্ব ও আধিপত্য বিস্তার। চাঁদাবাজি, অপহরণ ও হত্যাসহ নানা অপরাধে লিপ্ত তারা। তিন পার্বত্য জেলার মধ্যে বান্দরবান কিছুদিন তুলনামূলক শান্ত থাকলেও বর্তমানে বেশ সন্ত্রাস প্রবণ হয়ে পড়েছে। এর সর্বশেষ উদাহরণ সশস্ত্র গ্রুপ কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) আবির্ভাব। তাদের উৎপাতে স্থানীয়রা আতঙ্কিত। ফলে রুমা, রোয়াংছড়ি ও থানচি এখন পর্যটক শূন্য।
পাহাড়ের স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ২ যুগেরও বেশি সময় ধরে চলা সংঘাত বন্ধে আঞ্চলিক রাজনৈতিক দল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) সাথে চুক্তি করে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়। এর মূল কথা কথা ছিল, পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং সেজন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান ও আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়েছিল।
এর মধ্যে ছিল তিন পার্বত্য জেলার স্থানীয় সরকার পরিষদ সমন্বয়ে একটি আঞ্চলিক পরিষদ গঠন করা হবে। উপজাতীয় আইন এবং সামাজিক বিচারকাজ এই পরিষদের অধীনে থাকবে; পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় গঠন করা; উপজাতীয়দের ভূমি মালিকানা অধিকার ফিরিয়ে দেয়া; পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প প্রত্যাহার করা ইত্যাদি৷
পাহাড়ের অন্যতম সমস্যা ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০০১ সালে গঠন করা হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন। এ পর্যন্ত ছয়বার কমিশনের চেয়ারম্যান পরিবর্তন হলেও ভূমি বিরোধ সমস্যা সমাধানে কোনো সফলতা আসেনি।
তিন পার্বত্য জেলা থেকে ভূমি বিরোধ নিয়ে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রায় ২২ হাজার দরখাস্ত জমা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব আবেদনের সুরাহা করা হয়নি।
অবশ্য চুক্তির ব্যাপারে সরকার দাবি করছে পার্বত্য চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে এ পর্যন্ত ৬৫টি ধারা সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন করা হয়েছে। কিন্তু জনসংহতি সমিতির দাবি ৭২টি ধারার মধ্যে মাত্র ২৫টি ধারা বাস্তবায়ন হয়েছে। ১৮টি ধারার আংশিক বাস্তবায়ন হয়েছে। এ কারণে সুফল মিলছে না।
সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, পাহাড়ে সশস্ত্র তৎপরতায় লিপ্ত থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে স্বাধীনতার পর থেকে চুক্তির পূর্ববর্তী সময়ে নিহত, আহত ও অপহরণ কিংবা নিখোঁজের শিকার হয়েছেন অন্তত ৮ হাজার ১৪০ জন। নিহতদের মধ্যে ১ হাজার ১৩৮ জন পাহাড়ি। বাঙালি আছেন ১ হাজার ৪৪৬ জন। এই সময়ে বিভিন্ন বাহিনীর ৩৮০ জন সদস্য নিহত হয়েছেন।
আর শান্তি চুক্তি হওয়ার পরও ৯০২ জন পাহাড়ি, ৩৯০ বাঙালি এবং সামরিক-আধাসামরিক বাহিনীর ২৬ জনসহ ১ হাজার ৩১৫ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় ১ হাজার ৮২৩ জন। চুক্তি পরবর্তী সময়ে পাহাড়ে অপহরণের শিকার হয়েছেন ২ হাজার ১৯৮ জন।
তবে অভিযোগ রয়েছে, চুক্তি পরবর্তী সময়ে শর্ত ভঙ্গ করে জেএসএস'র সশস্ত্র গেরিলারা ‘শান্তিবাহিনী’ বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও বাস্তবে এখনো তাদের কার্যক্রম পাহাড়ে বহাল তবিয়তে রয়েছে। তাছাড়াও চুক্তির আগে পাহাড়ে শুধুমাত্র শান্তিবাহিনী নামে একটি সশস্ত্র সংগঠন ছিল। কিন্তু চুক্তির পর বিগত ২৭ বছরে ছয়টি আঞ্চলিক দলের সৃষ্টি হয়েছে পাহাড়ে। এসব দল নিজেরাও অভ্যন্তরীণ বিরোধেও জড়াচ্ছে।
এগুলো হচ্ছে ‘পিসিজেএসএস’র সশস্ত্র গ্রুপ, জেএসএস সংস্কার ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) ও তার সশস্ত্র গ্রুপ, মগ লিবারেশন আর্মি বা মগ পার্টি সশস্ত্র গ্রুপ এবং সর্বশেষ কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ)’র কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ) সশস্ত্র গ্রুপ’।
এ সশস্ত্র গ্রুপগুলোর কারণে পাহাড়ে চাঁদাবাজি, অপহরণ, খুন, গুমও বৃদ্ধি পেয়েছে গণহারে। এই অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনার জন্য অবৈধ অস্ত্রের চোরাচালান আসছে বিদেশ থেকে প্রতিনিয়ত। এছাড়াও এদের আধিপত্য বিস্তারের ঘটনায় পাহাড়ে দিনের পর দিন অশান্তি বৃদ্ধি পেয়েই চলছে। বিগত ২৭ বছরের এই সশস্ত্র গ্রুপগুলো ঘটিয়েছে কয়েক শতাধিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। অপহরণ ও চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটিয়েছে অগনিত।
বিগত সাত বছরে শুধুমাত্র বান্দরবানে (২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ সাল) সন্ত্রাসীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৭ জন সেনা সদস্যসহ ৫২ জন পাহাড়ি-বাঙালি মানুষ।
পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান কাজী মজিবুব রহমান বলেন, পার্বত্য চুক্তি হয়েছিল পাহাড়ে স্থায়ীভাবে শান্তির প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে। তবে, চুক্তির ২৭ বছরেও পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা হয়নি। বরং অশান্তি অনেক গুণ বেড়েছে। এখানে বিভিন্ন সশস্ত্র গ্রুপ তৈরি হয়েছে। জেএসএস, জেএসএস সংস্কার, মূল ইউপিডিএফ, ইউপিডিএফ গণতান্ত্রিক, মগ লিবারেশন পার্টি (এমএলপি) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টসহ (কেএনএফ) একাধিক সশস্ত্র গ্রুপের জন্ম হয়েছে। প্রতিনিয়ত চলছে অবৈধ অস্ত্রের মহড়া, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, গুম, খুন ও অপহরণ। এসব সন্ত্রাসী দলগুলোই আলাদা আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র দাবি করছে।
তিনি বলেন, যেকোন চুক্তির মাধ্যমে দু’পক্ষে লাভবান করে দিতে হয়। পার্বত্য চুক্তির মাধ্যমে একটি পক্ষকে (পাহাড়ি সম্প্রদায়) লাভবান করা হয়েছে আর অপরপক্ষকে (বাঙালি সম্প্রদায়) ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে।
তবে পাহাড়ি নেতাদের দাবি, চুক্তির মৌলিক শর্তগুলো আজও বাস্তবায়ন হয়নি। পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি কমিশন গঠিত হলেও তা এখনো অকার্যকর। তিন পার্বত্য জেলা পরিষদ ও আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাচন নেই। পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ আইন অকার্যকর। ফলে প্রতিষ্ঠা পায়নি পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকার চুক্তি বাস্তবায়নের নামে কালক্ষেপণ করেছে দাবি করে বান্দরবান সার্ক মানবাধিকার ফাউন্ডেশনের সহসভাপতি সেনাবাহিনীর সাবেক সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার অং চ মং মারমা বলেন, চুক্তি বাস্তবায়ন হলে সশস্ত্র গ্রুপগুলো পাহাড়ে সক্রিয় থাকতে পারতো না।
চুক্তি সম্পাদনকারী অপরপক্ষ পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ও আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য কে এস মং বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সরকারিভাবে চুক্তির বর্ষপূর্তি পালনের উদ্যোগ নেওয়ায় আমরা চুক্তি বাস্তবায়ন ও পার্বত্য সমস্যা সমাধানে আশাবাদী।
তিনি পাহাড়ে খুন, অপরণ ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত থাকা সশস্ত্র গ্রুপগুলোর বিষয়ে বলেন, পাহাড়ে যতগুলো গ্রুপ ও উপ-গ্রুপ রয়েছে, তাদের প্রতি বিশেষ সমর্থন প্রত্যাহার হলেই সমস্যা সমাধান হয়ে যাওয়ার কথা। কারণ জনগণের প্রয়োজনে গ্রুপ ও উপ-গ্রুপগুলো সৃষ্টি হয়নি।
ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) বান্দরবান শাখার সভাপতি উবামং মারমা বলেন, পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়ায় পাহাড়ের সশস্ত্র গ্রুপগুলো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিচ্ছে। এছাড়াও ভারতের মত প্রতিবেশী দেশ চট্টগ্রামকে অস্থিতিশীল করতে নানাভাবে সংকট সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
স্থানীয় সচেতন মহল মনে করেন শুধুমাত্র শান্তিচুক্তি বাস্তবায়নে পাহাড়ে শান্তি ফিরে আসবে না। পাহাড়ে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমত্যে ভিত্তিতে উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। শান্তিচুক্তির যুগোপযোগীকরণ অত্যন্ত জরুরি।