চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) চারুকলা ইনস্টিটিউটকে মূল ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। তবে তারা দ্রুততম সময়ে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দাবি জানিয়েছেন এবং শীতকালীন ছুটির (২০-২৬ ডিসেম্বর) পরও দুই কার্যদিবসের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি না হলে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
মঙ্গলবার (১৭ ডিসেম্বর) বিকেল সাড়ে ৪টায় নগরীর বাদশামিয়া সড়কের ইনস্টিটিউটের শিল্পী রশিদ চৌধুরী আর্ট গ্যালারির সামনে সংবাদ সম্মেলন করে এসব বলেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা।
এসময় লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার হাসান সোহেল ও নাফিসা তালুকদার। সঙ্গে ছিলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের চট্টগ্রামের সমন্বয়ক ও চবির শিক্ষার্থী খান তালাত মাহমুদ রাফি।
শাহরিয়ার হাসান সোহেল বলেন, চারুকলা বিভাগের যাত্রা শুরু ১৯৭০ সালে। এটি প্রথমে বাংলা বিভাগের অধীনে থাকলেও পরে স্বতন্ত্র বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় ঐতিহ্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। শিল্পী রশিদ চৌধুরী, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ, মুর্তজা বশীরের মতো বরেণ্য শিল্পীদের হাত ধরে এ বিভাগ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে খ্যাতি অর্জন করে। অথচ ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ২০১০ সালে এটি মূল ক্যাম্পাস থেকে সরিয়ে চট্টগ্রাম শহরে স্থানান্তর করা হয়।
তিনি অভিযোগ করেন, চারুকলাকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করার নেপথ্যে অধ্যাপক জসিম উদ্দীন ও তার সহযোগীরা রাজনৈতিক লিয়াজোঁ করে তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের সমর্থন নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছেন। একই সঙ্গে এই স্থানান্তরের মাধ্যমে শিল্পী রশিদ চৌধুরীর স্বপ্নের চারুকলা কলেজকেও হত্যা করা হয়েছে।
শাহরিয়ার আরও বলেন, চারুকলা বিভাগকে শহরে সরিয়ে নেওয়ার পর থেকে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও বৈষম্য চরমে পৌঁছেছে। শিক্ষার্থীদের দাবি উপেক্ষা করে বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেছে প্রশাসন। ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থীরা 'চারুকলাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ভূখন্ডে প্রত্যাবর্তন চাই' দাবিতে আন্দোলন শুরু করলে তৎকালীন সরকারের মদদপুষ্ট মহল আন্দোলন দমন করতে দফায় দফায় হামলা চালায়। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও শিক্ষা উপমন্ত্রী দাবির যৌক্তিকতা স্বীকার করেও বাজেট স্বল্পতার অজুহাতে তা বাস্তবায়ন করেননি।
শিক্ষার্থী নাফিসা তালুকদার বলেন, চারুকলার অধিকাংশ শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। শহরে অবস্থান করে থাকা-খাওয়ার ব্যয় বহন করা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য। তবুও গত ১৪ বছরে শিক্ষার্থীদের জন্য পর্যাপ্ত আবাসন সুবিধা নিশ্চিত করা হয়নি। মাত্র ২৫ আসনবিশিষ্ট একটি ছাত্র হোস্টেল থাকলেও নারী শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো আবাসন নেই। এছাড়া, মূল ক্যাম্পাসে থাকা স্বল্প ব্যয়ে খাবার, লাইব্রেরি, সাংস্কৃতিক সংগঠন, খেলার মাঠ এবং অন্যান্য সুবিধা থেকেও বঞ্চিত রাখা হয়েছে চারুকলার শিক্ষার্থীদের।
তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ক্যাম্পাস থেকে ২২কিলোমিটার দূরে বিচ্ছিন্ন করে আমাদের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এতে শুধু শিক্ষার্থীরা নয়, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের শিল্পচর্চার ক্ষতি হচ্ছে।
চারুকলার শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, চারুকলাকে মূল ক্যাম্পাসে ফেরানোর সিদ্ধান্ত সঠিক সময়েই নেওয়া হয়েছে। তবে এটি বাস্তবায়নে আর দেরি সহ্য করা হবে না। বারবার প্রতিশ্রুতি ভঙ্গের পরও আন্দোলন থামেনি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। এটি বাস্তবায়নে গত ১৫ ডিসেম্ব একাডেমিক মিটিং এ বসার প্রতিশ্রুতি দিলেও ইতিমধ্যে তারা তাদের প্রতিশ্রুতির বরখেলাফ করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা খান তালাত মাহমুদ রাফি বলেন, সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন চারুকলাকে মূল ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নেয়ার আশ্বাস দিলেও তার কোনো কার্যকরি পদক্ষেপ এখনো আমরা দেখিনি। এমন কি যে একাডেমিক মিটিং বসার কথা বলেছি সেটিও হয়নি। তাই আমরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা প্রশাসনের আর কোনো মৌখিক কথায় আশ্বস্ত হতে পারছি না।
তিনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে আল্টিমেটাম দিয়ে বলেন, আগামী শীতকালীন বন্ধের (২০-২৬ ডিসেম্বর) পর বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই কার্যদিবসের মধ্যে যদি চারুকলা প্রত্যাবর্তন বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে মূল ক্যাম্পাসে ফিরেয়ে নিতে হবে। না হয় আমরা চবির শিক্ষার্থীরা কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হব।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ দেশের শিল্পচর্চার বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। শিল্পী রশিদ চৌধুরী, সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদসহ বরেণ্য শিল্পীদের হাত ধরে দেশের শিল্পাঙ্গনে চারুকলার অবদান অবিস্মরণীয়। মূল ক্যাম্পাসে ফেরানোর মাধ্যমে সেই ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।