সামিটের দৌরাত্ম্যে অসহায় ছিল বিদ্যুৎ বিভাগ

রাষ্ট্রের প্রয়োজনে নয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়েছে সামিটের চাওয়ায়

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ছবি: বার্তা২৪.কম

ছবি: বার্তা২৪.কম

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এমনকি বিদ্যুৎ বিভাগের পরিকল্পনাও বদলে যেতো সামিট গ্রুপের চাপে। দেশের স্বার্থ বিবেচনায় নয়, বিদ্যুৎ কেন্দ্র হয়েছে স্রেফ শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ মুহাম্মদ আজিজ খানের চাওয়ায়। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নথিপত্রে থেকে গেছে যার প্রমাণ।

এসব ঘটনায় যেমন রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে, তেমনি অপরিকল্পিত বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের।

বিজ্ঞাপন

পিডিবি সুত্রে জানা গেছে, সরকারি ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি শান্তাহার ৫২ মেগাওয়াট এবং সৈয়দপুর ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র অনুমোদন দেয় ২০১১ সালের ১ জুন। তেল ভিক্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি যথা সময়ে নির্মাণে ব্যর্থ হলে কয়েক দফায় তাগাদাপত্র দেওয়া হয় সামিট গ্রুপকে। শেষ পর্যন্ত অগ্রগতি না হওয়ায় আইন অনুযায়ী সামিটের ১২ লাখ ডলার জামানত বাজেয়াপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় পিডিবি। সে অনুযায়ী জামানত বাজেয়াপ্ত করার নোটিশও দেওয়া হয়েছিল পিডিবির পক্ষ থেকে।

কথা ছিল চিঠির পর সামিটের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু প্রভাবশালী আজিজ খানের হুমকি-ধামকিতে সবকিছু বদলে যায়। তৎকালীন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হকের নির্দেশে নোটিশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয় পিডিবি। উল্টো সময় বর্ধিত করে শান্তাহার ও সৈয়দপুরের পরিবর্তে নারায়নগঞ্জের মদনগঞ্জ ও বরিশালে কেন্দ্র স্থাপনের সুপারিশ দেওয়া হয় সামিটের চাওয়া অনুযায়ী। যা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের মাস্টারপ্লানের সঙ্গে ছিল সারসরি সাংঘর্ষিক।

বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি উত্তরাঞ্চলে নির্মাণ উদ্যোগের প্রধান লক্ষ্য ছিল উত্তরাঞ্চলের সান্ধ্যাকালীণ লোডশেডিং দূর করা। ওই সময়ে (২০১২ সাল) আশুগঞ্জ ও সিলেট অঞ্চলে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হতো। দীর্ঘ সঞ্চালন লাইনের কারণে একদিকে যেমন সিস্টেম লস হতো তেমনি ভোল্টেজ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন ছিলো। এতে করে ট্রান্সফরমার পুড়ে যাওয়া, বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়া ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। নিরবচ্ছিন্ন ও মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটি যুক্ত করা হয়েছিল মাস্টার প্লানে। শুধুমাত্র সামিটের অতি মুনাফালোভি মানসিকতায় ভন্ডুল হয়ে যায় সব পরিকল্পনা। তৎকালীন আইপিপি সেল-৩ এর পরিচালক জাকির হোসেনকে বাধ্য করা হয় স্থানান্তর করার অনুমোদন দিতে। অসহায় পিডিবি তখন নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে বাধ্য হয়।

তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দুটির জন্য জ্বালানি পরিবহনের খরচের পয়সা লুট করতে ওই জালিয়াতির আশ্রয় নেন বিদ্যুৎ খাতের ডন খ্যাত আজিজ খান। সৈয়দপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র তেল সরবরাহ করতে হলে চট্টগ্রাম থেকে নৌ পথে বাঘাবাড়ি, সেখান থেকে রেল অথবা সড়কপথে জ্বালানি সরবরাহ করার কথা। যার খরচ তাদের চুক্তির মধ্যেই ধরা ছিল। সেই পরিবহন খরচ কমানোর নাম করেই কেন্দ্র দুটি বরিশাল ও মেঘনাঘাটে নিয়ে যাওয়া হয়। অথচ স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হলেও সামিটকে আগের হিসাবেই পরিবহন খরচ বরাদ্দ দেওয়া হয় বলে পিডিবি সুত্র নিশ্চিত করেছে। ১৫ বছর মেয়াদী বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর জন্য সামিট পাওয়ার লিমিটেড ও কনসোর্টিয়াম অব সামিট ইন্ডাষ্ট্রিয়াল এন্ড মার্কেন্টাইল করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তি করে পিডিবি। শুধু ওই দু’টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রই নয়, যোগ্যতা না থাকলেও বৃহৎ ৩টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিবিয়ানা-১ , ২ ও ৩ সামিটের হাতে তুলে দেয় সদ্য বিতারিত শেখ হাসিনা সরকার। কাছাকাছি সময়ে দেওয়া হয় মেঘনাঘাট ৩৫০ মেগাওয়াট কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্টও।বিবিয়ানায় অর্থায়ন করতে ব্যর্থ হলেও নিয়ম বর্হিভূতভাবে দফায় দফায় সময় বাড়ায় আওয়ামী লীগ সরকার। “বিবিয়ানা-১ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি আইপিপি (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্ল্যান্ট) হওয়ায় এখানে সরকারের অর্থায়নের কোনো দায় ছিলো না। নির্ধারিত সময়ে কাজ শুরু করতে না পারায় চুক্তি বাতিল ও সামিটের ৩০ লাখ (তিন মিলিয়ন) ডলার জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার কথা। কিন্তু বিদ্যুৎ বিভাগ সামিটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ারই সাহস দেখায় নি।

শুধু বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থানান্তর নয়, মদনগঞ্জের ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বিপিসিকেও জিম্মি করে সামিট গ্রুপ।

আইন অনুযায়ী সকল ধরণের জ্বালানি তেল আমদানির একক এখতিয়ার বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কমিশনের (বিপিসি)। সেই বিপিসিকেও ভয়ভীতি দেখিয়ে জ্বালানি তেল আমদানির অনুমোদন বাগিয়ে নেন আজিজ খান। ২০১৩ সালের জুলাইয়ে সামিট গ্রুপকে বছরে ১ লাখ টন ফার্নেস অয়েল আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয় সম্পুর্ন বেআইনিভাবে। তখন আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিপিসি আপত্তি তুললেও পাত্তাই পায় নি তারা।

বিপিসিকে দমাতে সামনে থেকে দিক নির্দেশনা দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক ই-ইলাহী চৌধুরী ও বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী এনামুল হক। জনশ্রুতি রয়েছে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় বিপিসি চেয়ারম্যানকে প্রকাশ্য হুমকি দিয়েছিলেন প্রতিমন্ত্রী। পরে বাধ্য হয়ে সামিট গ্রুপকে ফার্নেস অয়েল আমদানির অনুমতির ছাড়পত্র দেয় বিপিসি।

তখন চলছিল সামিটের মগের মুল্লুক, এই খাতের অনেকেই প্রকাশ্যে বলার সাহস না করলেও পেছনে বলতেন আজিজ মুল্লুক। বলতেন, রাষ্ট্রীয় আইন ও আচার তাদের কাছে চানাচুরের ঠোঙ্গার পুরাতন কাগজের টুকরো মাত্র। আইন, নীতিমালা, মাস্টারপ্ল্যান কোনকিছুই বিবেচ্য বিষয় ছিল না। বিদ্যুতে তাই হয়েছে সামিট গ্রুপ যা চেয়েছে। বছরের ১ লাখ টন তেল আমদানির জন্য সামিটকে ট্যাক্স অব্যহতি দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, উল্টো সরকারই ৯ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দেয় সামিট পাওয়ারকে।

সামিট গ্রুপকে যখন তেল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়, তখন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা অনেকেই আপত্তি তুলেছিলেন। তাদের মতামত ছিল এতো করে ওভার ইনভয়েস করে টাকা পাচার করার সুযোগ তৈরি হবে, হয়েছেও তাই। একাধিক দফায় সামিটের তেল আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং এর তথ্য পায়, বিপিসি ও কাস্টমস। যদিও পরে সামিটের চাপে সবকিছু হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। দেখা গেছে একই সময়ে বিপিসি যে দামে ফার্নেস অয়েল কিনেছে তার থেকে দেড়গুণ দামে আমদানি দেখিয়ে টাকা পাচার করে কোম্পানিটি।

কয়েক বছর আগেও ছোট-খাটো ব্যবসায়ী থাকলেও এখন সিঙ্গাপুরের মতো জায়গাতেও শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীর তালিকায় জায়গা পেয়েছেন আজিজ খান। ফোর্বস ২০২৪ সালের বিলিয়নিয়ারদের যে তালিকা প্রকাশ করেছে, সেখানে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। তালিকায় ২ হাজার ৫৪৫ নম্বরে রয়েছে তার নাম, যার মোট সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ডলার এবং আয়ের খাত হিসেবে রয়েছে জ্বালানি। ফোর্বসের তথ্য অনুসারে, আজিজ খান বর্তমানে সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। এর আগে তিনি সিঙ্গাপুরের ৪১তম ধনী ব্যক্তি হিসেবে জায়গা করে নিয়েছিলেন।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট শওকত আজিজ রাসেল সম্প্রতি এক সেমিনারে বলেছেন, পরিস্থিতি জটিল ও ভয়াবহ মনে হচ্ছে। দেশের লোকাল কোম্পানি রাতারাতি সিঙ্গাপুরী কোম্পানি হয়েগেলো, আগে দেশে টাকা দিতাম, এখন সিঙ্গাপুরে ডলার পৌঁছে দিচ্ছি। এ কারণেই আজকের ডলারের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে। আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা হয়েছে।

সমিট গ্রুপের দেশের বাইরে কোম্পানি খোলা ও টাকা নিয়ে যাওয়া নিয়ে রয়েছে নানারকম বিতর্ক। অনেক সময় ওভার ইনভয়েস ও আন্ডার ইনভয়েসের মাধ্যমে টাকার পাচারের অভিযোগ রয়েছে সামিট গ্রুপের বিরুদ্ধে। বিদ্যুতের পাশাপাশি জ্বালানি খাতকেও জিম্মি করে ব্যবসায়ী আদায় করেছেন। মহেশখালীতে তাদের একটি এফএসআরইউ রয়েছে, মংলায় আরও একটি এফএসআরইউ দেওয়া হচ্ছে। ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নিয়েও নানারকম মুখরোচক আলোচনা রয়েছে বাজারে।

সামিট গ্রুপের মালিকানাধীন রয়েছে ১৮ বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এরমধ্যে ৭টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের তথ্যে দেখা গেছে ১৩২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন ওই ৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিপরীতে প্রতিমাসে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে ১২৫ কোটি ৫৬ লাখ টাকার উপরে। জুলাই-২১ থেকে মার্চ-২২ (৯ মাস) মাসে ৭ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে ১ হাজার ১৬১ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।

বলা হচ্ছে, সামিট গ্রুপ, কনফিডেন্স গ্রুপ, ইউনাইটেড গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপের মতো কিছু কোম্পানির হাতের পুতুল হিসাবে কাজ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। প্রয়োজন না থাকলেও তাদের চাওয়া পুরণ করতে গিয়ে দফায় দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে রেন্টাল, কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের। এমনকি মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়ার পর রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে আইপিপি বানিয়ে বসিয়ে বসিয়ে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হয়েছে।