আ.লীগ বিদায় হলেও দোসর ইউনাইটেড গ্রুপ বহাল তবিয়তে

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

ইউনাইটেড গ্রুপ

ইউনাইটেড গ্রুপ

বিদ্যুৎ খাতে মাফিয়া হয়ে ওঠা ইউনাইটেড গ্রুপ এখনও বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। দুই বিদ্যুৎ কেন্দ্র দিয়ে গ্রাহকের পকেট কাটা অব্যাহত রেখেছে কোম্পানিটি। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে নিয়ম নীতি এমনকি হাইকোর্টের আদেশ উপেক্ষা করে দেওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি এখনও চালু থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন অনেকেই।

ঢাকা ইপিজেডে থাকা ৮৬ মেগাওয়াট এবং চট্টগ্রাম ইপিজেডে থাকা ৭২ মেগাওয়াট গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র দু’টি ইউনাইটেড গ্রুপের কাছে সোনার ডিম দেওয়া হাঁসে পরিণত হয়েছে। গ্যাস দিয়ে ইউনিট প্রতি বিদ্যুৎ উৎপাদনে যখন খরচ পড়ছে ৪.১৭ টাকা, সেই বিদ্যুৎ ১০.৮৮ টাকা দরে বিক্রি করছে বিভিন্ন গ্রাহকের কাছে। ক্ষেত্র বিশেষে এই দর আরও অনেক বেশি। 

বিজ্ঞাপন

প্রতি ঘণ্টায় ১ লাখ ৫৮ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম কেন্দ্রগুলো। একদিনের (২৪ ঘণ্টা) যোগফল দাঁড়ায় ৩৭ লাখ ৯২ হাজার ইউনিট। ইউনিট প্রতি ১ টাকা মুনাফা থাকলে বিশাল অংক দাঁড়ায়, সেখানে প্রায় (অপরেশন খরচের পর) চার টাকার উপরে মুনাফা লুটছে। কোম্পানি ধুয়া তুলছে সরকারি বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানির তুলনায় সাশ্রয়ী দরে বিক্রি করছে। এই কথা বলে বোকা বানানোর অপচেষ্টা চলছে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড নানান উৎস থেকে বিদ্যুৎ কিনে থাকে। এখানে যেমন ৪.১৭ টাকা মূল্যের গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ রয়েছে, তেমনি কয়লা ৮ থেকে ১২ টাকা দরের কয়লা বিদ্যুৎ, ১৬-১৮ টাকা দরের ফার্নেস অয়েল এবং ২৮ টাকা দরের ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎ রয়েছে। সবগুলোর গড় দর অনেক বেশি হবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সরকার ঘনিষ্ঠ ইউনাইটেড গ্রুপ সবচেয়ে কম দামের উৎস (গ্যাস) থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে গ্রাহকের পকেট কাটা অব্যাহত রেখেছে।

বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির গ্যাসের দর নিয়ে নজিরবিহীন জালিয়াতির ঘটনা হয়েছে। তখন ক্যাপটিভ পাওয়ারের (শিল্পে নিজস্ব ব্যবহারের জন্য বিদ্যুৎ কেন্দ্র) ক্ষেত্রে গ্যাসে দর ছিল ৩০ টাকা (প্রতি ঘনমিটার), আর সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৬ টাকা। ইউনাইটেড গ্রুপ সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দরে গ্যাসের দাম দাবি করলে বিষয়টি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনে গড়ায়।

রেগুলেটরি কমিশন ইউনাইটেড গ্রুপের দাবি নাকচ করে দেন। এরপর বিষয়টি গড়ায় হাইকোর্টে, সেখানে নাকচ হলে সুপ্রিম কোর্ট গিয়েও হেরে যান ইউনাইটেড গ্রুপ। তারপর সকল আইন-কানুন উপেক্ষা করে নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দর কমিয়ে দেওয়া হয়। কথিত রয়েছে তৎকালীন সরকারের উচ্চ মহলের সঙ্গে বিশেষ সমঝোতায় গ্যাসের দাম কমিয়ে দেওয়া হয়। কথিত রয়েছে মুনাফার হিস্যা দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যেত।  

শুধু গ্যাসের দরে জালিয়াতি নয়, ইউনাইটেড গ্রুপ দেশের একমাত্র প্রতিষ্ঠান যারা নিজেদের ইচ্ছা অনুযায়ী বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করার ক্ষমতা সংরক্ষণ করে। এ ক্ষেত্রে বিইআরসির সমান্তরাল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে ইউনাইটেড গ্রুপ। অন্যান্য ক্ষেত্রে বিইআরসি বিদ্যুতের দাম নির্ধারণ করলেও ইউনাইটেড গ্রুপ তাদের নির্ধারিত দরে বিক্রি করছে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনে সরকারি, বেসরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্র বিদ্যমান। আইপিপি ক্যাটাগরিতে থাকা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরকারের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সরকারের কাছে বিক্রি করবে। তাদের বাইরে বিদ্যুৎ বিক্রি করার কোন ‍সুযোগ নেই। আবার ক্যাপটিভকে কমার্শিয়াল ক্যাটাগরি বলা হচ্ছে, এ ক্ষেত্রে নিজস্ব কারখানায় ব্যবহারের পর উদ্বৃত্ত বিদ্যুৎ শর্তসাপেক্ষে বাইরে বিক্রি করার সীমিত সুযোগ রয়েছে। সেখানেও দর নির্ধারণের এখতিয়ার বিইআরসিকে দেওয়া হয়েছে আইনে।

অথচ ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির ঢাকা ইপিজেড এলাকায় ৮৬ মেগাওয়াট ও চট্টগ্রাম ইপিজেডে অবস্থিত ৭২ মেগাওয়াট গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে কোন রকম আইন মানা হয় নি। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি যেহেতু সরকারের কাছে বিদ্যুৎ বিক্রি করে না তাই ক্যাপটিভ বিবেচনায় গ্যাসের দাম ঘনমিটার প্রতি ৩০ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসি। একই সময়ে আইপিপির (ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার) জন্য গ্যাসের দর ছিল ১৬ টাকা।

কথিত রয়েছে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে রেগুলেটরি কমিশনের দ্বন্দ্বের সূত্রপাতও এখান থেকেই। যার রেশ ধরে বিইআরসির হাত থেকে গ্যাস ও বিদ্যুতের দর নির্ধারণের প্রক্রিয়া ছিনিয়ে নেয় নির্বাহী বিভাগ। ইউনাটেড গ্রুপের জন্য ১৬ টাকা দর নির্ধারণের জন্য মন্ত্রণালয় থেকে চাপ দেওয়া শুরু হয়। এই নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিইআরসির মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু হয়।

বিইআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল সাফ জানিয়ে দেন, আইন কোন ভাবেই আইপিপি হিসেবে কভার করে না। তাই ক্যাপটিভের দরেই (৩০ টাকা) তাদের গ্যাসের মূল্য দিতে হবে। বিদ্যুৎ বিভাগের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করেই আদেশ বহাল রাখে রেগুলেটরি কমিশন।

বিইআরসির তৎকালীন চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল বার্তা২৪.কমকে বলেন, আইনগতভাবে বিষয়টি আইপিপি হওয়ার কোন সুযোগ নেই। আমরা সেই রায় দিয়েছিলাম। পরে কি হয়েছে আমার জানা নেই।

বিইআরসির তৎকালীন সদস্য (গ্যাস) মকবুল ই-এলাহী চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, আমার কাছে বিষয়টি অষ্টম আশ্চর্য্য মনে হয়। কিভাবে তারা আইপিপির দর পেলো বুঝতে পারি না। তারা বিইআরসিতে এলে আমরা নাকচ করে দেই, পরে রিভিউয়ের আবেদন করে সেখানেও নাকচ হয়ে যায়। আমি যতদূর জানি হাইকোর্টও তাদের নাকচ করে দিয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, তাদের প্রকল্পের শুরুই হয়েছে ক্যাপটিভ হিসেবে। আইপিপি হওয়ার কোন সুযোগ দেখি না। ইউনাইটেডের পক্ষে চাপ দিতে একজন লোক এসেছিল। আমরা তাকে স্রেফ জানিয়ে দেই ভবিষ্যতে যেনো আর কখনও নাক না গলান।

ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম এক প্রশ্নের জবাবে বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, এই লাইসেন্স রাষ্ট্রের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী। রাষ্ট্রের সংবিধান আইন ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। বেসরকারি কোন কোম্পানিকে ডিস্ট্রিবিউশন লাইসেন্স দেওয়ার এখতিয়ার নেই। কিন্তু ইউনাইটেড গ্রুপ ডিস্ট্রিবিউশন করছে। প্রধানমন্ত্রী কি আইনের ঊর্ধ্বে, তিনি নির্দেশ দিলেই অনুমোদন দেওয়া যাবে? এটা দেওয়ার এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর ছিল না।

গ্যাসের দর প্রসঙ্গে বলেন, তারা তো ক্যাপটিভ শ্রেণির, তাদেরকে আইপিপির রেটে গ্যাস দেওয়ার কোন সুযোগ নেই।

আওয়ামী লীগ সরকারের ছত্রছায়ায় ইউনাইটেড গ্রুপ এমন সব নজির গড়েছে যা শুধু বাংলাদেশে নয়, সারা বিশ্বে বিরল। আইনের সজ্ঞা, ব্যাখ্যা সবই বদলে ইউনাইটেড পাওয়ার জেনারেশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ইউপিজিডি) নতুন সত্ত্বা হিসাবে আর্বিভূত হয়েছে। সরকার পরিবর্তনের পর দৌরাত্ম্য কমে যাওয়া  আশা করছিলেন খোদ পিডিবির লোকজন। কিন্তু অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় এখনও ছড়িয়ে ঘুরিয়ে যাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ে বিদ্যুৎ খাতের মাফিয়া হিসেবে আর্বিভূত হয় গ্রুপটি। আশুগঞ্জে ১৯৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের দরপত্র জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির সঙ্গে সিন্ডিকেট করে অন্যদের দরপত্র কৌশলে বাতিল করে নিজেরা চড়া দরে কাজ নেন। বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির ২৯ শতাংশ শেয়ার আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানিকে দেওয়ার কথা থাকলেও মাত্র ৬ শতাংশ শেয়ার দেওয়া হয়েছে। খুলনায় অবস্থিত ২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র তিন বেচা দিয়েছেন। কেপিসিএল-২ (১১৫ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎ কেন্দ্র ২০১০ সালে প্রথম ৫ বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রথম ৫ বছরেই তাদের বিনিয়োগ তুলে নিলেও, এরপর ২০১৬ সালে আবারও ক্যাপাসিটি প্রেমেন্টের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকা হাওয়া করে দেন।

বার্তা২৪.কম এর পক্ষ থেকে ইউনাইটেড গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ম্যানেজিং ডিরেক্টর মঈনুদ্দীন হাসান রশীদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তার কাছে প্রশ্ন ছিল, বিইআরসি নাকচ করে দেওয়া, হাইকোট ও সুপ্রিম কোর্ট নাকচ করে দেওয়ার বিষয়টি কতটা সঠিক। জবাবে বলেন, আমাদের সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি ভালো বলতে পারবে।