এগ্রিকোর বিদ্যুৎকেন্দ্র, যার মুনাফা জুয়ার-বাজিকে হার মানিয়েছে
এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের ঘোড়াশাল ১৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র মুনাফা জুয়ার-বাজিকেও পরাজিত করেছে। ১০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করে ক্যাপাসিটি চার্জ (ভাড়া বাবদ) হাতিয়েছে ২১ কোটি ১৪ লাখ ১০ হাজার ডলার।
কোম্পানিটির উন্মুক্ত দরপত্রে পাওয়া বিদ্যুৎকেন্দ্র মাঝ পথে বিশেষ আইনে সময় ও অর্থ বাড়িয়ে দিয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। উন্মুক্ত দরপত্রে ৩ বছরের চুক্তিতে ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা ছিল ২১ ডলার (প্রতি কিলোওয়াটের জন্য)। ডিজেল ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি দেড় বছরের মাথায় দ্বৈত জ্বালানির (ডিজেল ও গ্যাস) অনুমোদন দেওয়া হয়। আর এখানেই বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে যোগসাজসে তোপ দাগেন কোম্পানিটি। ক্যাপাসিটি চার্জ ২১ ডলার থেকে বাড়িয়ে ৩০ ডলার করা হয়। ভাড়ার মেয়াদ বেড়ে গেলে ক্যাপাসিটি চার্জ কমে আসার কথা, কিন্তু এগ্রিকোর ক্ষেত্রে ঘটেছে উল্টো। চুক্তিতে রাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ নয়, গুরুত্ব পেয়েছে কোম্পানির মুনাফা। আর এতেই কয়েকগুণ বেশি টাকা হাতাতে সক্ষম হয় কোম্পানিটি।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, প্রথম চুক্তি অনুসারে প্রতি মাসে ৩০ লাখ ৪৫ হাজার ডলার ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হতো। সে হিসেবে ৩৬ মাসের ক্যাপাসিটি চার্জ ধরা হয়েছিল ১০ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার ডলার। ভাড়াভিত্তিক এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রথম চুক্তিতেই বিনিয়োগ ও পরিচালন ব্যয় ধরেই খরচ নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু নজির বিহীনভাবে বিশেষ বিধান আইনে ক্যাপাসিটি চার্জ ও চুক্তির মেয়াদ ১৮ মাস বাড়ানো হয়।
এখানেই থামানো যায় নি রহস্যজনক কোম্পানিটিকে, সাড়ে ৪ বছর মেয়াদ শেষে আরও ৩ বছরের জন্য চুক্তি করা হয়।এতে করে মোট ক্যাপাসিটি চার্জ গিয়ে ঠেকেছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকায়। আর কোম্পানিটির প্রাথমিক বিনিয়োগ ছিল মাত্র ৭০০ কোটি টাকার মতো। এক বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়েই হাতিয়েছে আড়াই ১৮০০ কোটি টাকা। অথচ তখন বেজড লোড বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করলে ৯০০ কোটি (মেগাওয়াট ৬ কোটি) টাকায় হয়ে যেতো। তেমন বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হলে ওই খরচে ২০ থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া যেতে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ২০১১-১২ বার্ষিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই অর্থবছরে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে পাওয়া প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের দাম পড়েছে ১২.৯৫ টাকা। তখন গ্যাস দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খরচ ছিল ২ টাকার নিচে। ওই বছর একই এলাকায় অবস্থিত আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশন কোম্পানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনতে খরচ পড়েছে মাত্র ১.৯২ টাকা, আর ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানির বিপরীতে খরচ পড়েছে ১.৫১ টাকা। অর্থাৎ কয়েকগুণ বেশি মূল্য দেওয়ার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। তবু পিডিবি দফায় দফায় তাদের চুক্তি বাড়িয়ে গেছে। জনশ্রুতি রয়েছে এগ্রিকোর মাধ্যমেই চড়াদরের চুক্তির সূচনা হয়। যা পরে অন্যান্য কোম্পানিও পেয়ে যায়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, টেকসই উন্নয়নের পথে না হেঁটে উল্টো বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে দুর্নীতির সুযোগ করে দেওয়াই গত সরকারের মূল লক্ষ্য ছিল বলে মনে হচ্ছে।
এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের ঘটনা উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকেই।
বিদ্যুতে নানা রকম লুটপাটের ঘটনা ঘটলেও এভাবে চুক্তির পর ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা নজির বিহীন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের এই চুক্তি নিয়ে নানা রকম জনশ্রুতি রয়েছে। কোম্পানিটির মালিকানার বিষয়টি রহস্যাবৃত।
কোম্পানিটির বাংলাদেশে লোকাল এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছে ইনফ্রাদেব অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেড। যার মালিকানায় রয়েছে সরাফত চৌধুরী সাদি। প্রবাসী ওই বাংলাদেশি সাবেক সচিব ড. সাদাত হোসেনের দূরসম্পর্কের আত্মীয় বলে জানা গেছে। তিনি নিজেকে তৌফিক ই-ইলাহী চৌধুরীর আত্মীয় হিসেবে পরিচয় দিতেন। তার ক্ষমতার দাপটে পিডিবির অনেক চাওয়া বদলে যেতো। পিডিবি ও বিদ্যুৎ বিভাগের বড় কর্তাদের তুমি বলে সম্বোধন করতেন। অনেকে বিব্রত হলেও তৌফিক ই-চৌধুরীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার কারণে মুখ খোলার সাহস দেখান নি। কথিত রয়েছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর বাড়তি মুনাফার বখরা পেতেন খোদ তৌফিক ই-ইলাহী চৌধুরী। যা তাকে দেশের সীমানার বাইরে পৌঁছে দেওয়া হয়ে থাকতে পারে।
ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরে এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালকে আরও দু’টি বিদ্যুৎকেন্দ্র দেওয়া হয়। এগুলো হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০১১ সাল, কাছাকাছি সময়ে ২০১১ সালের ৩১ মে উৎপাদনে আসে আশুগঞ্জ ৯৫ মেগাওয়াট আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র। এটিও তিন বছরের জন্য লাইসেন্স পায়। তবে অদৃশ্য জাদুর ছোঁয়ায় কয়েক দফা চুক্তির মেয়াদ বৃদ্ধির পর মোট আট বছর করে চলে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর ক্যাপাসিটি চার্জ নির্ধারণ করা হয় ৩০ ডলার ধরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৮৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিপরীতে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা, এবং আশুগঞ্জ ৯৫ মেগাওয়াটের বিপরীতে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা। কেন্দ্র দুটির বিপরীতে প্রায় ২৭০০ কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে পিডিবি।
এসব অসম চুক্তির প্রভাব পড়ে গড় বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচে। বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) তথ্য অনুযায়ী, গড় উৎপাদন খরচ ২ টাকার নীচে থাকলেও কয়েক বছরেই আকাশ চুম্বি হয়েছে। ২০২২ সালে সাড়ে ৮ টাকার মতো, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে গড় উৎপাদন খরচ ১১.৫১ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেছেন, প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ গড়ে বিক্রি করছি ৮.৯৫ টাকা দরে, আর কিনছি ১২ থেকে ২৫ টাকা পর্যন্ত। কেনো বেশি দামে কেনা হলো, কারা চুক্তি করেছেন, কেনো করেছেন! বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করেছেন তারা কি তখন মনে করেন নি, এতো বেশি দামে কেনো নিচ্ছি, তারা কি জাতিকে ক্ষতিপূরণ দিবেন!
এগ্রিকো ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশি এজেন্ট সরাফত চৌধুরী সাদির সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করা হয়। তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায়, হোয়াটাসঅ্যাপে মেসেজ দিলেও সাড়া পাওয়া যায় নি।
সরাফত চৌধুরী সাদির ছোট ভাই ইনফ্রাদেব অ্যাসোসিয়েটস লিমিটেডের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার রবিন চৌধুরী বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্র পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো রকম অনিয়ম হয় নি। যা হয়েছে সবকিছু নিয়ম অনুযায়ী হয়েছে।
উন্মুক্ত দরে ২১ ডলারে চুক্তি চলমান অবস্থায় দর ও সময় বাড়িয়ে নেওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারবো না। আপনি পিডিবির সঙ্গে যোগাযোগ করেন।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টার সঙ্গে পারিবারিক আত্মীয়তা ও পার্টনারশিপের জনশ্রুতি বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন, এগুলো যারা বলেন তারা না জেনে ভুল কথা বলেছেন। এগ্রিকো নিয়ম অনুযায়ী ব্যবসা করেছে।
জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, সরাফত চৌধুরী সাদি, তার কোম্পানি ও ঘনিষ্ঠদের ব্যাংক হিসাবে ধরে টান দিলে টাকা পাচারের বড় রহস্য বেরিয়ে আসতে পারে। এর সঙ্গে অনেক রাঘববোয়াল জড়িত থাকতে পারে।