শেভরনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ

  • সেরাজুল ইসলাম সিরাজ, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, ঢাকা
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

শেভরনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ, ছবি: সংগৃহীত

শেভরনের প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ, ছবি: সংগৃহীত

অফশোর পিএসসির (উৎপাদন ও বণ্টন চুক্তি) শর্তে অনশোরে চুক্তির প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে পেট্রোবাংলা। বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন সুনামগঞ্জ, শেরপুর ও ময়মনসিংহ এলাকা নিয়ে গঠিত ১১ নম্বর ব্লক ও হবিগঞ্জে অবস্থিত ব্লক-১২ এর বর্ধিত এলাকায় মডেল পিএসসির আলোকে চুক্তির প্রস্তাব করেছিল।

ব্লক-৮, ব্লক-১১ ও ব্লক-১২ নম্বরের পার্শ্ববর্তী এলাকায় (রশিদপুর) তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিষয়টি সামনে আসে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে। শেভরনের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই সময় রশিদপুরের বিষয়টি নাকচ করে বিশেষ বিধান আইনের আওতায় ব্লক-৮ ও ১১ বিষয়ে সবুজ সংকেত প্রদান করেছিল আওয়ামী লীগ সরকার। তখন তাদের বিস্তারিত প্রস্তাব দিতে বলা হয়েছিল।

বিজ্ঞাপন

সম্প্রতি শেভরন বাংলাদেশ নতুন করে প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবে অফশোর (সাগর) মডেল পিএসসি ২০২৩ এর আলোকে চুক্তির প্রস্তাব দেয়। পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে সেই প্রস্তাব নাকচ করে দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলন অনেক ব্যয়বহুল এবং ঝুঁকিপুর্ণ, সে কারণে সেখানে গ্যাসের দর অনেক বেশি হয়ে থাকে। স্থলভাগে ওই দর অনুযায়ী চুক্তি হতে পারে না।

গ্যাসের দাম বৃদ্ধিসহ অনেক ছাড় দিয়ে মডেল পিএসসি-২০১৯ সংশোধন করে মডেল পিএসসি-২০২৩ করা হয়। আগের পিএসসিগুলোতে গ্যাসের দর স্থির করে দেওয়া হলেও এবার গ্যাসের দর নির্ধারিত করা হয় নি। ব্রেন্ট ক্রুডের আন্তর্জাতিক বাজার দরের সঙ্গে ওঠানামা করবে গ্যাসের দর। প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাসের দাম ধরা হয়েছে ব্রেন্ট ক্রুডের ১০ শতাংশ দরের সমান। অর্থাৎ ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ১০০ ডলার হলে গ্যাসের দাম হবে ১০ ডলার। যা বিদ্যমান পিএসসিতে যথাক্রমে অগভীর ও গভীর সমুদ্রে ৫.৬ ডলার ও ৭.২৫ ডলার স্থির দর ছিল। অন্যদিকে শেভরন বাংলাদেশের ব্লক-১২ এলাকায় ইজারা দেওয়া হয়েছে ২.৭৬ ডলারে।

বিজ্ঞাপন

দামের পাশাপাশি সরকারের শেয়ারের অনুপাতও নামিয়ে দেওয়া হয়েছে পিএসসি-২০২৩ এ। গভীর সমুদ্রে ৩৫ থেকে ৬০ শতাংশ এবং অগভীর সমুদ্রে বাংলাদেশের হিস্যা ৪০ থেকে ৬৫ শতাংশ পর্যন্ত ওঠানামা করবে। ঠিকাদার নির্ধারিত সময়ে মধ্যে কূপ খনন করে গ্যাস না পেলে কিংবা, বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনযোগ্য না হলে শর্তসাপেক্ষে যথাক্রমে ১ ও ২ শতাংশ হিস্যা বাড়ানোর সুযোগ রাখা হয়েছে।

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্স ১১ নম্বর ব্লকের একটি অংশে ত্রিমাত্রিক জরিপ করেছে বাপেক্স। সম্ভাবনাময় ১১ নম্বর ব্লকে ২ দশমিক ৪৭ ট্রিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মজুত রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। শেভরন বাংলাদেশ এসব ব্লকে দ্বিমাত্রিক ও ত্রিমাত্রিক জরিপ করার কথা। জরিপের ফলাফল ইতিবাচক হলে পরবর্তী ধাপে (কূপ খনন) যেতে চায় কোম্পানিটি।

বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ মোট ৩টি ব্লক থেকে গ্যাস উত্তোলন করছে। তাদের হাতে রয়েছে ব্লক-১২ নম্বরে থাকা বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র, ব্লক-১৩ নম্বরে থাকা জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্র এবং ব্লক-১৪ নম্বরে থাকা মৌলভীবাজার গ্যাসক্ষেত্র। শেভরন বাংলাদেশের মালিকানাধীন ৩টি গ্যাসক্ষেত্র থেকে দৈনিক (২৮ জানুয়ারি) ১১২৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তোলন করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের মোট উৎপাদিত গ্যাসের অর্ধেকের চেয়েও অনেক বেশি। ২৮ জানুয়ারি দেশীয় গ্যাসফিল্ডগুলোর মোট উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ১৯০৫ মিলিয়ন ঘনফুট।

আইন অনুযায়ী চুক্তির পর ৭ বছর কোনো কাজ না করলে স্বয়ংক্রিভাবে ওই এলাকায় পেট্রোবাংলার অধীনে চলে যাবে। শেভরন বাংলাদেশ ব্লক-১২ চুক্তি করলে পরে কিছু এলাকা ছেড়ে দেয়। ২০২২ সালের অক্টোবরে বিবিয়ানা ফিল্ডের ছেড়ে দেওয়া কিছু এলাকায় কূপ খনন করতে ত্রিপক্ষীয় সম্পূরক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ, পেট্রোবাংলা ও শেভরন বাংলাদেশ। কোম্পানিটি নতুন করে রশিদপুরের কিছু এলাকায় পাওয়ার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

পেট্রোবাংলার একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিষয়টি নিশ্চিত করলেও তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হন নি। অন্যদিকে শেভরন বাংলাদেশের ঢাকা অফিসে যোগাযোগ করা হলে ম্যানেজার (মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন) শেখ জাহিদুর রহমান বার্তা২৪.কমকে বলেছেন, এই মুহূর্তে শেভরন বাংলাদেশ তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রকাশ করতে চায় না।

তিনি আরও বলেন, শেভরন বাংলাদেশ, সরকার ও পেট্রোবাংলার সঙ্গে ৩০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। বাংলাদেশকে সাশ্রয়ী, নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ করে যাচ্ছে। জ্বালানি খাতের সম্ভাবনা অন্বেষণ অব্যাহত রাখতে চায়।

শেভরনের কাছে জানতে চাওয়া হয় প্রস্তাব নাকচের পর এখন কি ভাবছে তারা। এ প্রশ্নের জবাবে বলা হয়েছে, শেভরন বাংলাদেশ তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা প্রকাশ করতে চায় না।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান রেজানুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি রিসিভ করেন নি। এমনকি এসএমএস দিলেও সাড়া দেন নি।

অন্যদিকে ব্লক-১২ চুক্তির মেয়াদ ২০৩৪ সালে শেষ হয়ে যাচ্ছে। শেভরন বাংলাদেশ ওই চুক্তির মেয়াদ আরও ৫ বছর বাড়িয়ে ২০৩৯ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। সময় বাড়ানোর প্রস্তাবও নাকচ করা হয়েছে। পেট্রোবাংলা মনে করছে ২০৩৪ সাল অনেক সময় রয়েছে, এ বিষয়ে এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আসেনি।

সম্প্রতি মাসে বকেয়া পাওনা পরিশোধের জন্য তাগাদা দিয়েছে কোম্পানিটি। গ্যাস বিল বকেয়া থাকায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ব্যাহত হচ্ছে, দ্রততম সময়ের মধ্যে কমপক্ষে ৭৫মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করার জন্য চিঠি দিয়েছে। কোম্পানিটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও প্রেসিডেন্ট এরিক এম ওয়াকার ৯ জানুয়ারি চিঠি দিয়েছেন। ২৮ জানুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিটির গ্যাস বিল পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৭০ মিলিয়ন ডলারে।