অতিবাণিজ্যে এবারও পূরণ হয়নি হজ কোটা

  • স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

পবিত্র কাবা, ছবি: সংগৃহীত

পবিত্র কাবা, ছবি: সংগৃহীত

২০২৫ সালে হজে যাওয়ার জন্য নিবন্ধনের শেষ তারিখ ছিল বৃহস্পতিবার। শেষ দিন পেরোলেও খালি রয়েছে ৪৩ হাজার ৬৭১ কোটা। ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জনের বিপরীতে প্রাথমিক নিবন্ধন সেরেছেন ৮৩ হাজার ৫৮৭ জন। কাঙ্ক্ষিত সাড়া না পেয়ে নিবন্ধনের সময়সীমা তিন দফা বাড়ায় ধর্ম মন্ত্রণালয়। তার পরও কোটা ফাঁকা রয়ে গেল। এবার নিয়ে টানা তিন বছর হজযাত্রীদের কোটা পূরণে ব্যর্থ হলো বাংলাদেশ। এর ফলে হজের সঙ্গে জড়িত ব্যবসাগুলো প্রভাবিত হবে বলে আশঙ্কা করেছেন হজ এজেন্সির মালিকরা।

জানা গেছে, ২০২৩ সালে কোটার চেয়ে ৩ হাজার ৯৮০ জন এবং ২০২৪ সালে ৪১ হাজার ৯৪১ জন কম যাত্রী হজপালন করেন। তখনও হজের কোটা ছিল এবারের মতো এক লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন।

বিজ্ঞাপন

হজ একটি পবিত্র ইবাদত। কয়েকটি শর্তে ফরজ ইবাদতের একটি। কিন্তু হজকে ঘিরে চলা নানা অনৈতিক ক্রিয়াকর্মের পবিত্রতায় ছেদ ফেলছে কিনা সন্দেহ দেখা দিয়েছে। পবিত্র ইবাদতটিকেও কোথায় এনে ঠেকানো হয়েছে সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। দিন দিন কঠিন করে তোলা হচ্ছে হজপালন। নানা নিয়মের বেড়াজালে হজ ব্যবস্থাপনা কঠিন ও ব্যয়বহুল হয়ে যাওয়ার কারণে মানুষ নফল উমরার দিকে বেশি ঝুঁকছে।

জানা যায়, খরচ অনেক বেড়ে যাওয়ায় বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ২৪ হাজার ২৩৭ জন প্রাক-নিবন্ধনকারী হজের চূড়ান্ত নিবন্ধন করেননি। এই বিপুল সংখ্যক প্রাক-নিবন্ধনকারী চূড়ান্ত নিবন্ধন না করায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো। অন্যান্য বছর হজ নিবন্ধনের সুযোগ পেতে প্রতিযোগিতা চলত।

বিজ্ঞাপন

অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার হজ প্যাকেজ ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ঘোষণা করা হয়েছে। প্যাকেজ মূল্যের তারতম্য আর সৌদি কর্তৃপক্ষের নিত্য-নতুন হজ ব্যবস্থাপনার বিধান আরোপ হজ ব্যবস্থাপনাকে জটিল করে তুলেছে। সেই সঙ্গে বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলোর কমিটি না থাকায় ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সেভাবে আলাপ-আলোচনা করে অনেক কিছুই সমাধান করতে পারেনি। ধর্ম মন্ত্রণালয় ও এজেন্সিগুলোর দূরত্বের কারণে এবারও হজ কোটা পূরণ হয়নি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বেসরকারি এজেন্সিগুলোর অভিযোগ, এমন অব্যবস্থাপনা ও পরিস্থিতি একদম ঠাণ্ডা মাথায় তৈরি করা হয়েছে। তার ওপর হজ ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের মূল নেতৃত্বে থাকা শীর্ষ কর্তাদের হজ-সংক্রান্ত কর্মকাণ্ডে তেমন অভিজ্ঞতা নেই। এ সুযোগটি কাজে লাগিয়েছেন অন্যরা। নানান সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছেন তারা। এই তারা কারা? তার উত্তর খোঁজা খুবই জরুরি। ইবাদতকে ব্যবসায় নিয়ে ঠেকাতে কামিয়াব এ মহলটি বরাবরই কোনো না কোনোভাবে লাভবান।

বিশিষ্ট ইসলামি চিন্তাবিদ মুফতি অহিদুল আলম বলেন, হজ একটি বড় রকমের ইবাদত বলে এর দিকে ব্যবসায়িক নজর থাকবে না- এমন নীতিকথার সুযোগ নেই। নীতি-নৈতিকতা, ভয়, ভক্তি এখানে খাটে না। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তো হজ নিয়ে এতো ব্যবসা হয় না, সে কথা বলার জায়গাও নেই। বরং ‘কেউ না গেলে নাই’- এমন সাফ কথার বাজার আছে। হজপ্রার্থীরা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের খরচের তফাৎ জানেন না, এমনও নয়। নিজ গরজেই তারা তা সংগ্রহ করেন। কিন্তু, তাতে কিছু যায়-আসে না। জনসংখ্যা বিচারে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়ার হজযাত্রীদের খরচ অনেক কম। মালয়েশিয়ার খরচ খুব বেশি না। প্রতিবেশী ভারতে হজে ভর্তুকি বন্ধ করে দেওয়া হলেও খরচ আমাদের মতো নয়। এসব নিয়ে প্রতি বছরই কথা হয়। বচসা জমে। কারো পছন্দ না হলে বা সামর্থ্যে না কুলালে না যাবেন- এ সাফ কথায় বাদবাকি যুক্তি আর টেকে না।

মূলত হজ নিয়ে খরচের বড় অংশ ব্যয় হয় সৌদি আরবের বাড়ি ও উড়োজাহাজ ভাড়ায়। আর সৌদি সরকারের বিভিন্ন সেবার জন্যও ভালো একটি অংশ দিতে হয়। এ ক্ষেত্রে উড়োজাহাজ ভাড়া কমাতে পারে সরকার। হজ প্যাকেজের খরচের অনেকগুলোর ধাপের মধ্যে উড়োজাহাজ ভাড়া একটি। এখানেই পাখির চোখ সবার, বেসরকারি হজ এজেন্সিগুলো শুধু প্লেন ভাড়াকেই টার্গেট করে বলতে থাকে, প্লেন ভাড়া কমানো হোক, প্লেন ভাড়া কমানো হোক। কারণ প্লেন ভাড়া কমালে এজেন্সি মালিকদের কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু হজ প্যাকেজের বাকি ধাপের মধ্যে বাড়িভাড়া কমানো হলে এজেন্সি মালিকদের ব্যবসায় কম লাভ হবে। অনেক এজেন্সি হজের সময় মক্কা-মদিনায় আবাসন ব্যবসা করে, তাদের লাভের অংশ কমে যাবে।

গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে দফায় দফায় নিবন্ধন পেছানোর রহস্য আরও নানা দিকে ছড়ানো। এর ফিরিস্তিও বেশ লম্বা, কারণ এ ইবাদতটির সঙ্গে বেশ অর্থনৈতিক সংযোগ বিদ্যমান। এ সুযোগে বণিকরা হজকে করে ফেলেছে বিজনেস আইটেম। ব্যবসা হাতানোর প্রবণতায় অনেকে ঝুঁকেছেন এ ব্যবসায়, যাদের অনেকে আবার ম্যান পাওয়ার ব্যবসায় সম্পৃক্ত। হজ তাদের কাছে একটি মৌসুমী ব্যবসা। তাদের অফিস থাকে। নতুন করে অফিস নিতে হয় না। আদম ব্যবসায়ীদের মতো তাদেরও সংগঠন আছে। হজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-হাব নামের সংগঠনটি তা দেখভাল করে। নানা দ্বন্দ্বে যদিও এখন সংগঠনটির কোনো কমিটি নেই। তবে সেখানে নির্বাচনী হাওয়া বইছে, সে আরেক কাহিনি।

ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুসারে, ২০১৫ সালে হজের জন্য সর্বনিম্ন খরচ ছিল দুই লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে তিন লাখ চার হাজার টাকা। ২০১৭ সালে সর্বনিম্ন প্যাকেজ ছিল তিন লাখ ১৯ হাজার টাকার। ২০১৮ সালে ছিল তিন লাখ ৩১ হাজার টাকা। ২০১৯ সালে তিন লাখ ৪৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারির কারণে ২০২০, ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে সীমিত পরিসরে হজে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। সর্বনিম্ন খরচ ধরা হয়েছিল চার লাখ ৫৬ হাজার।

২০২৩ সালে সরকারিভাবে হজ প্যাকেজের খরচ ধরা হয় ছয় লাখ ৮৩ হাজার টাকা। আর ২০২৪ সালে প্যাকেজ ধরা হয় পাঁচ লাখ ৭৯ হাজার টাকা। ২০২৫ সালে হজে যেতে সরকারিভাবে দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। ঘোষিত সাশ্রয়ী প্যাকেজ অনুযায়ী খরচ ধরা হয়েছে চার লাখ ৭৯ হাজার ২৪২ টাকা। অন্য প্যাকেজে খরচ ধরা হয়েছে পাঁচ লাখ ৭৫ হাজার ৬৮০ টাকা। তবে প্যাকেজে খাবারের ৪০ হাজার ও কোরবানির জন্য ৭৫০ সৌদি রিয়াল আলাদাভাবে নিতে বলা হয়েছে। গত বছর খাবার টাকা প্যাকেজে যুক্ত ছিল।

তবে এবারের প্যাকেজে ২০২৪ সালের চেয়ে প্লেনভাড়া অন্তত ২৭ হাজার টাকা কমানো হয়েছে। এসব হিসাব ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে সংগ্রহ করা হলেও খরচের তারতম্য বিস্তর। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসাবে বিবেচনায় নিলে এটা স্পষ্ট যে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৫ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে। যেমন খাবারের ৪০ হাজার টাকা যোগ করলে প্যাকেজ-১-এর খরচ দাঁড়ায় ৫ লাখ ১৮ হাজার ২৪২ টাকা। আর প্যাকেজ ২-এর জন্য খরচ ৬ লাখ ১৫ হাজার ৬৮০ টাকা। তাহলে দেখা যাচ্ছে, ২০১৯ সালের তুলনায় হজের খরচ বেড়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার টাকা।

হজ নিয়ে বাণিজ্য হয়, আর এই অভিযোগ শুধু বেসরকারি এজেন্সির মালিকদের শুনতে হয়, এটা কেন? সৌদি আরবে বাংলাদেশ হজ মিশন আছে। জেদ্দা কনসাল জেনারেল (হজ) আছেন, তারা চাইলেই সৌদি আরবে সরকারি নিবন্ধিত হাজিদের বাড়িভাড়া করতে পারেন। তার পরও ধর্ম মন্ত্রণালয় থেকে লোকবলের বিশাল বহর নিয়ে সৌদি আরবে যান সরকারিভাবে বাড়ি ভাড়ার জন্য, এটা নিয়ে তো কেউ কথা বলে না? এভাবেই ক্ষোভ জানাচ্ছিলেন এক এজেন্সির মালিক।

তিনি বলেন, হজ ব্যবস্থাপনায় বেসরকারি এজেন্সিগুলোর একজন অন্তত পঞ্চাশ জনকে সেবা দেন। কিন্তু সরকারি ৫ হাজার হাজির জন্য যে লোক বহর যায়, তাদের সেবা কি হাজিরা পান? বিভিন্ন দলভুক্ত হয়ে যারা হাজিসেবার জন্য সৌদি আরব যান তাদের কারা সুবিধা করে দেয়, ঘুরেফিরে কিছু লোকের নামই কেমনে যুক্ত হয়, এগুলো খুঁজে দেখা দরকার।

তিনি আরও বলেন, প্রতি বছর দেশ থেকে সরকারি কর্মকর্তাদের সৌদি নেওয়া হয় হজে সহায়তাকারী হিসেবে। এতে দেশের প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়। এটা বন্ধ করে সৌদি আরবে অবস্থানরত বাংলাদেশিদের দায়িত্ব দেওয়া যায়, কিন্তু কোনো এক অজানা কারণে ধর্ম মন্ত্রণালয় এগুলো দেখেও দেখে না। এটাও বাণিজ্যের অংশ। এগুলো নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার।