দৃষ্টিহীনতা জয় করে জাকিয়ার জিপিএ-৫

  • তাসনীম হাসান, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট, বার্তা২৪.কম, চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • |
  • Font increase
  • Font Decrease

জাকিয়া আফরিন

জাকিয়া আফরিন

জন্মের পরেই ধরা পড়ে জাকিয়া আফরিনের দৃষ্টিশক্তি একটু কম। ক্রমেই সেই দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে উঠে। একেবারে নিভে যায় দু’চোখের সব আলো। শৈশবেই চোখের সঙ্গী হয়ে উঠে ভারী চশমা। বড় মেয়ের এই দুরবস্থা দেখে ভেঙে পড়েন মা-বাবা। তবে আশা হারাননি কেউই, মেয়েকে নিয়ে বাড়িয়ে দেন প্রচেষ্টা।

অদম্য ইচ্ছে, পড়াশোনার প্রতি টান আর মা-বাবার অক্লান্ত শ্রম—এই তিনের জেরে এই বারের এইচএসসি পরীক্ষায় সাফল্যের আলো মাখল একদিন সবার চোখে বাতিলের খাতায় পড়ে যাওয়া জাকিয়া। মঙ্গলবার (১৫ অক্টোবর) প্রকাশিত এইচএসসি পরীক্ষার ফলে জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন তিনি। চট্টগ্রাম নগরীর হাজেরা তজু ডিগ্রি কলেজের মানবিক বিভাগ থেকে জাকিয়া এই সাফল্য পেয়েছেন।

বিজ্ঞাপন

অথচ একটা সময় দৃষ্টিহীন হওয়ায় পড়ালেখা তো বটেই, জীবনের সব আশাও থেমে যাওয়ার পথে ছিল জাকিয়ার। তার পরেও অদম্য ইচ্ছাশক্তির জোরে প্রাথমিক থেকে একের পর এক ধাপ পেরিয়ে এবার জাকিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে।

জাকিয়া তাই বললেন, ‘আমার সংগ্রামের গল্পটা অনেক লম্বা। তবে সেই সংগ্রামের পরতে পরতে আছে মা-বাবার অসাধারণ চেষ্টা, শিক্ষক-বন্ধুদের আন্তরিকতাও। সবার ভালোবাসাতেই আমার এই অর্জন।’

এসএসসিতে মনের মতো ফল পাননি জাকিয়া। জাকিয়ার জিপিএ-৫ পাওয়ার স্বপ্ন সেবার থেমে যায় ৪ দশমিক ৩৯-এ এসেই। সেজন্য পরের দুই বছর পড়াশোনায় কোনো কমতি রাখেননি এই ছাত্রী।

জাকিয়া সেই সব স্মৃতি আরেকবার তুলে ধরে বললেন, ‘অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও মনের জোরকে সম্বল করে লক্ষ্যে অবিচল থাকলে কোনো কিছুই অসম্ভব নয়। এসএসসিতে খারাপ ফলের পর একেবারে ভেঙে পড়েছিলাম। তখনই পরবর্তী লক্ষ্য ঠিক করে নিয়েছিলাম। গত দুই বছর অনেক পরিশ্রম করেছি। নিয়ম মেনে পড়াশোনা করেছি। তার ফল যেন পেলাম। এখন তাই আনন্দটা দ্বিগুণ হয়েছে।’

জাকিয়ার বাসা চট্টগ্রাম নগরীর হামজারবাগে, আর কলেজ ছিল পুরাতন চান্দগাঁও থানা এলাকায়। প্রায় চার কিলোমিটারের এই যাত্রায় তাকে দিনে দু’বার করে সঙ্গ দিতেন বন্ধুরা। সেই বন্ধুদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে জাকিয়ার বক্তব্য, ‘বন্ধুরা না থাকলে অনেক আগেই হয়তো থেমে যেত সবকিছু। তারা আমার সমস্যা থাকায় নিয়মিত আসা-যাওয়ায় দেখভাল করতো।’

জাকিয়ার বাবা মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম এনজিওতে কর্মরত। আর মা ফেরদৌসি বেগম গৃহিণী। বাড়ি শেরপুরে হলেও চাকরির সূত্রে বহু বছর ধরে চট্টগ্রাম নগরীতেই বাস তাদের। তিন বোনের মধ্যে বড়জন জাকিয়া। আরেক বোনও তার মতোই দৃষ্টিহীন।

মেয়ের এমন সাফল্যে গর্বে বুক ভরে যাচ্ছে মা ফেরদৌসি বেগমের। সেই উচ্ছ্বাস ধরা পড়ল তার কণ্ঠেও, ‘আল্লাহর প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা। মেয়ে চেষ্টা করেছে। পেছন থেকে আমরাও সবকিছু দিয়ে সহযোগিতা করেছি। আজ সেই সব কষ্টের ফল পেলাম। মেয়ের এই সাফল্যের জন্যই এতদিন অপেক্ষায় ছিলাম। আমার মেয়ে দেখিয়ে দিল-দৃষ্টিহীন মানেই সব শেষ নয়।’

দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের পাশে থেকে সব রকমের সহযোগিতা আর অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছেন সরকারি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক আবদুস সামাদ। জাকিয়া এই বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী। প্রাক্তন ছাত্রীর জিপিএ-৫ পাওয়ার বিষয়টি নিজের ফেসবুকে তুলে ধরে উচ্ছ্বাসের কথা জানিয়েছিন আবদুস সামাদ।

যোগাযোগ করা হলে আবদুস সামাদ বলেন, ‘এখন চারপাশে প্রচুর প্রতিযোগিতা। এর মধ্যেও জাকিয়া দেখিয়ে দিল সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষদের চেয়ে সে কোনো অংশে কম নয়। নিজেদের আন্তরিকতা, অভিভাবকদের সচেতনতা, রাষ্ট্রের সুদৃষ্টি থাকলে আমার দৃষ্টিহীন ছেলে-মেয়েরাও একদিন বাঁধার সব পাহাড় ডিঙিয়ে বড় বড় জায়গায় পৌঁছে যাবে।’

এইচএসসিতে সাফল্যের পর এবার আরও দূরে দৃষ্টি ফেলেছেন জাকিয়া আফরিন। ভর্তি হতে চান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে, পড়তে চান ইংরেজি বিভাগে। একজীবনের স্বপ্ন দুটো-পড়াশোনা শেষে শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করে পরিবারের দায়িত্ব নেওয়া। আর তার মতো দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জগতটাকে আরও বড় করে দেওয়া।